পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৯৯

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 সুচরিতা কহিল, “গ্রীসে বোমেও তো মূর্তিপূজা ছিল।”

 গোরা কহিল, “সেখানকার মূর্তিতে মানুষের কল্পনা সৌন্দর্যবোধকে যতটা আশ্রয় করেছিল জ্ঞানভক্তিকে ততটা নয়। আমাদের দেশে কল্পনাজ্ঞান ও ভক্তির সঙ্গে গভীররূপে জড়িত। আমাদের কৃষ্ণরাধাই বলো, হরপার্বতীই বলো, কেবলমাত্র ঐতিহাসিক পূজার বিষয় নয়; তার মধ্যে মানুষের চিরন্তন তত্ত্বজ্ঞানের রূপ রয়েছে। সেই জন্যেই রামপ্রসাদের চৈতন্যদেবের ভক্তি এই-সমস্ত মূর্তিকে অবলম্বন করে প্রকাশ পেয়েছে। ভক্তির এমন একান্ত প্রকাশ গ্রীস-রোমের ইতিহাসে কবে দেখা দিয়েছে?”

 সুচরিতা কহিল, “কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম ও সমাজের কোনো পরিবর্তন আপনি একেবারে স্বীকার করতে চান না?”

 গোরা কহিল, “কেন চাইব না! কিন্তু পরিবর্তন তো পাগলামি হলে চলবে না। মানুষের পরিবর্তন মনুষ্যত্বের পথেই ঘটে- ছেলেমানুষ ক্রমে বুড়োমানুষ হয়ে ওঠে, কিন্তু মানুষ তো হঠাৎ কুকুর-বিড়াল হয় না। ভারতবর্ষের পরিবর্তন ভারতবর্ষের পথেই হওয়া চাই, হঠাৎ ইংরাজি ইতিহাসের পথ ধরলে আগাগোড়া সমস্ত পণ্ড ও নিরর্থক হয়ে যাবে। দেশের শক্তি দেশের ঐশ্বর্য দেশের মধ্যেই সঞ্চিত হয়ে আছে, সেইটে আমি তোমাদের জানাবার জন্যই আমার জীবন উৎসর্গ করেছি। আমার কথা বুঝতে পারছ?”

 সুচরিতা কহিল, “হাঁ, বুঝতে পারছি। কিন্তু এ-সব কথা আমি কখনো পূর্বে শুনি নি এবং ভাবি নি। নতুন জায়গায় গিয়ে পড়লে খুব স্পষ্ট জিনিসেরও পরিচয় হতে যেমন বিলম্ব ঘটে আমার তেমনি হচ্ছে। বোধ হয় আমি স্ত্রীলোক ব’লেই আমার উপলব্ধিতে জোর পৌঁচচ্ছে না।”

 গোরা বলিয়া উঠিল, “কখনোই না। আমি তো অনেক পুরুষকে জানি, এই-সব আলাপ-আলোচনা আমি তাদের সঙ্গে অনেক দিন ধরে করে আসছি- তারা নিঃসংশয়ে ঠিক করে বসে আছে তারা খুব বুঝেছে- কিন্তু আমি তোমাকে নিশ্চয় বলছি, তোমার মনের সামনে তুমি আজ যেটি

৪৮৯