পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৩৪

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

আমাদের সকলের উচিত হবে না? আমরাও কি হিন্দুকে পরিত্যাগ করে তার ক্ষয়কে বাড়িয়ে তুলব! এখনই তো তাকে প্রাণপণ শক্তিতে আঁকড়ে থাকবার সময়।”

 পরেশবাবু সস্নেহে সুচরিতার পিঠে হাত বুলাইয়া কহিলেন, “আমরা ইচ্ছা করলেই কি কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচিয়ে রাখতে পারি? রক্ষা পাবার জন্য একটা জাগতিক নিয়ম আছে সেই স্বভাবের নিয়মকে যে পরিত্যাগ করে সকলেই তাকে স্বভাবতই পরিত্যাগ করে। হিন্দুসমাজ মানুষকে অপমান করে, বর্জন করে; এই জন্যে এখনকার দিনে আত্মরক্ষা করা তার পক্ষে প্রত্যহই কঠিন হয়ে উঠছে। কেননা, এখন তো আর সে আড়ালে বসে থাকতে পারবে না— এখন পৃথিবীর চার দিকে রাস্তা খুলে গেছে, চার দিক থেকে মানুষ তার উপরে এসে পড়ছে- এখন শাস্ত্র-সংহিতা দিয়ে বাঁধ বেঁধে প্রাচীর তুলে সে আপনাকে সকলের সংস্রব থেকে কোনোমতে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। হিন্দুসমাজ এখনো যদি নিজের মধ্যে সংগ্রহ করবার শক্তি না জাগায়, ক্ষয়রোগকেই প্রশ্রয় দেয়, তা হলে বাহিরের মানুষের এই অবাধ সংস্রব তার পক্ষে একটা সাংঘাতিক আঘাত হয়ে দাঁড়াবে।”

 সুচরিতা বেদনার সহিত বলিয়া উঠিল, “আমি এ-সব কিছু বুঝি নে-কিন্তু এই যদি সত্য হয় একে আজ সবাই ত্যাগ করতে বসেছে, তা হলে এমন দিনে একে আমি তো ত্যাগ করতে বসব না। আমরা এর দুর্দিনের সন্তান বলেই তো এর শিয়রের কাছে আমাদের আজ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।”

 পরেশবাবু কহিলেন, “মা, তোমার মনে যে ভাব জেগে উঠেছে আমি তার বিরুদ্ধে কোনো কথা তুলব না। তুমি উপাসনা ক’রে, মন স্থির ক’রে তোমার মধ্যে যে সত্য আছে, যে শ্রেয়ের আদর্শ আছে, তারই সঙ্গে মিলিয়ে সব কথা বিচার করে দেখো; ক্রমে ক্রমে তোমার কাছে সমস্ত পরিষ্কার হয়ে উঠবে। যিনি সকলের চেয়ে বড়ো তাঁকে দেশের কাছে কিম্বা কোনো মানুষের কাছে খাটো কোরো না— তাতে তোমারও মঙ্গল না, দেশেরও না। আমি এই মনে করে একান্তচিত্তে তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণ

৫২৪