পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৪৯

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

আনা পূরণ করিতে হইবে। বিবাহ উপলক্ষে কন্যার পিতার বোঝা যাহাতে দুঃসহ হইয়া উঠে এইজন্য বরের পক্ষে সর্বপ্রকার কৌশল অবলম্বন করা হয়, হতভাগ্যের প্রতি লেশমাত্র করুণা নাই। গোরা দেখিল, এই সমাজ মানুষকে প্রয়োজনের সময় সাহায্য করে না, বিপদের সময় ভরসা দেয় না, কেবল শাসনের দ্বারা নতি স্বীকার করাইয়া বিপন্ন করে।

 শিক্ষিত সমাজের মধ্যে গোরা এ কথা ভুলিয়া ছিল- কারণ, সে সমাজে সাধারণের মঙ্গলের জন্য এক হইয়া দাঁড়াইবার শক্তি বাহির হইতে কাজ করিতেছে। এই সমাজে একত্রে মিলিবার নানাপ্রকার উদ্‌যোগ দেখা দিতেছে। এই-সকল মিলিত চেষ্টা পাছে পরের অনুকরণরূপে আমাদিগকে নিষ্ফলতার দিকে লইয়া যায়, সেখানে ইহাই কেবল ভাবিবার বিষয়।

 কিন্তু পল্লীর মধ্যে যেখানে বাহিরের শক্তিসংঘাত তেমন করিয়া কাজ করিতেছে না, সেখানকার নিশ্চেষ্টতার মধ্যে গোরা স্বদেশের গভীরতর দুর্বলতার যে মূর্তি তাহাই একেবারে অনাবৃত দেখিতে পাইল। যে ধর্ম সেবারূপে, প্রেমরূপে, করুণারূপে, আত্মত্যাগরূপে এবং মানুষের প্রতি শ্রদ্ধারূপে সকলকে শক্তি দেয়, প্রাণ দেয়, কল্যাণ দেয়, কোথাও তাহাকে দেখা যায় না- যে আচার কেবল রেখা টানে, ভাগ করে, পীড়া দেয়, যাহা বুদ্ধিকেও কোথাও আমল দিতে চায় না, যাহা প্রীতিকেও দূরে খেদাইয়া রাখে, তাহাই সকলকে চলিতে-ফিরিতে উঠিতে-বসিতে সকল বিষয়েই কেবল বাধা দিতে থাকে— পল্লীর মধ্যে এই মূঢ় বাধ্যতার অনিষ্টকর কুফল এত স্পষ্ট করিয়া এত নানা রকমে গোরার চোখে পড়িতে লাগিল, তাহা মানুষের স্বাস্থ্যকে জ্ঞানকে ধর্মবুদ্ধিকে কর্মকে এত দিকে এত প্রকারে আক্রমণ করিয়াছে দেখিতে পাইল যে, নিজেকে ভাবুকতার ইন্দ্রজালে ভুলাইয়া রাখা গোরা পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠিল।

 গোরা প্রথমেই দেখিল, গ্রামের নীচজাতির মধ্যে স্ত্রীসংখ্যার অল্পতাবশত অথবা অন্য যে কারণ বশত হউক অনেক পণ দিয়া তবে বিবাহের জন্য মেয়ে পাওয়া যায়। অনেক পুরুষকে চিরজীবন এবং অনেককে অধিক বয়স পর্যন্ত

৫৩৯