পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৬৫

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

সে আনন্দময়ীকে কেবলমাত্র ‘মা’ বলিয়া ডাকিয়া লইবার জন্য নানা উপলক্ষ সৃজন করিয়া তাঁহাকে ডাকিত। ললিতার বিবাহের সমস্ত কর্ম যখন সম্পন্ন হইয়া গেল তখন ক্লান্তদেহে বিছানায় শুইয়া পড়িয়া তাহার কেবল এই কথাই মনে আসিতে লাগিল, এইবার আনন্দময়ীকে ছাড়িয়া সে কেমন করিয়া চলিয়া যাইবে। সে আপনা-আপনি বলিতে লাগিল, ‘মা, মা, মা।’ বলিতে বলিতে তাহার হৃদয় স্ফীত হইয়া উঠিয়া দুই চক্ষু দিয়া অশ্রু ঝরিতে লাগিল। এমন সময় হঠাৎ দেখিল, আনন্দময়ী তাহার মশারি উদ্‌ঘাটন করিয়া বিছানার মধ্যে প্রবেশ করিলেন। তিনি তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া কহিলেন, “আমাকে ডাকছিলে কি?”

 তখন সুচরিতার চেতনা হইল, সে ‘মা মা’ বলিতেছিল। সুচরিতা কোনো উত্তর করিতে পারিল না, আনন্দময়ীর কোলে মুখ চাপিয়া কঁদিতে লাগিল। আনন্দময়ী কোনো কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন। সে রাত্রে তিনি তাহার কাছেই শয়ন করিলেন।

 বিনয়ের বিবাহ হইয়া যাইতেই তখনই আনন্দময়ী বিদায় লইতে পারিলেন না। তিনি বলিলেন, ‘ইহারা দুই জনেই আনাড়ি— ইহাদের ঘরকন্না একটুখানি গুছাইয়া না দিয়া আমি যাই কেমন করিয়া।’

 সুচরিতা কহিল, “মা, তবে এ ক’দিন আমিও তোমার সঙ্গে থাকব।”

 ললিতাও উৎসাহিত হইয়া কহিল, “হাঁ মা, সুচিদিদিও আমাদের সঙ্গে কিছুদিন থাক্।”

 সতীশ এই পরামর্শ শুনিতে পাইয়া ছুটিয়া আসিয়া সুচরিতার গলা ধরিয়া লাফাইতে লাফাইতে কহিল, “দিদি, আমিও তোমাদের সঙ্গে থাকব।”

 সুচরিতা কহিল, “তোর যে পড়া আছে বক্তিয়ার।”

 সতীশ কহিল, “বিনয়বাবু আমাকে পড়াবেন।”

 সুচরিতা কহিল, “বিনয়বাবু এখন তোর মাস্টারি করতে পারবেন না।”

 বিনয় পাশের ঘর হইতে বলিয়া উঠিল, “খুব পারব। এক দিনে এমনি কি অশক্ত হয়ে পড়েছি তা তো বুঝতে পারছি নে। অনেক রাত জেগে

৫৫৩