পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৭০

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 হরিমোহিনী কহিলেন, “শোনো একবার! এখনকার দিনে না দেখে কি এ-সব কাজ হবার জো আছে। সে বরঞ্চ সেকালে চলত। তোমার মেসে শুভদৃষ্টির পূর্বে আমাকে দেখেন নি।”

 এই বলিয়াই এই স্পষ্ট ইঙ্গিতের উপরে তাড়াতাড়ি আরও কতকগুলা কথা চাপাইয়া দিলেন। বিবাহের পূর্বে কন্যা দেখিবার সময় তাঁহার পিতৃগৃহে সুবিখ্যাত রায়-পরিবার হইতে অনাথবন্ধু-নামধারী তাঁহাদের বংশের পুরাতন কর্মচারী ও ঠাকুরদাসী-নাম্নী প্রবীণা ঝি, দুই জন পাগড়ি-পরা দণ্ডধারী দারোয়ানকে লইয়া কিরূপে কন্যা দেখিতে আসিয়াছিল এবং সেদিন তাঁহার অভিভাবকদের মন কিরূপ উদ্‌বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছিল এবং রায়-বংশের এইসকল অনুচরকে আহারে ও আদরে পরিতুষ্ট করিবার জন্য সেদিন তাঁহাদের বাড়িতে কিরূপ ব্যস্ততা পড়িয়া গিয়াছিল, তাহা বর্ণনা করিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন এবং কহিলেন, এখন দিনক্ষণ অন্যরকম পড়িয়াছে।

 হরিমোহিনী কহিলেন, “বিশেষ কিছুই উৎপাত নেই, একবার কেবল পাঁচ মিনিটের জন্যে দেখে যাবে।”

 সুচরিতা কহিল, “না।”

 সে ‘না’ এতই প্রবল এবং স্পষ্ট যে হরিমোহিনীকে একটু হটিতে হইল। তিনি কহিলেন, “আচ্ছা বেশ, তা নাই হল। দেখার তো কোনো দরকার নেই, তবে কৈলাস আজকালকার ছেলে, লেখাপড়া শিখেছে, তোমাদেরই মতো ও তো কিছুই মানে না, বলে ‘পাত্রী নিজের চক্ষে দেখব।’ তা, তোমরা সবার সামনেই বেরোও তাই বললুম, ‘দেখবে সে আর বেশি কথা কী, একদিন দেখা করিয়ে দেব।’ তা, তোমার লজ্জা হয় তো দেখা নাই হল।”

 এই বলিয়া কৈলাস যে কিরূপ আশ্চর্য লেখাপড়া করিয়াছে, সে যে তাহার কলমের এক আঁচড় মাত্রে তাহার গ্রামের পোস্ট্ মাস্টারকে কিরূপ বিপন্ন করিয়াছিল— নিকটবর্তী চারি দিকের গ্রামের যে-কাহারোই মামলামকদ্দমা করিতে হয়, দরখাস্ত লিখিতে হয়, কৈলাসের পবামর্শ ব্যতীত যে কাহারও এক পা চলিবার জো নাই, ইহা তিনি বিবৃত করিয়া বলিলেন।

৫৫৮