পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৮৮

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

করো বাবা। একটা চিঠি তাকে লিখে দাও।”

 গোরা মাথা নাড়িল। সে হইতেই পারে না। চিঠিপত্র নয়।

 হরিমোহিনী কহিলেন, “আচ্ছা, তুমি আমাকেই দু লাইন লিখে দাও। তুমি সব শাস্ত্রই জান, আমি তোমার বিধান নিতে এসেছি।”

 গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “কিসের বিধান?”

 হরিমোহিনী কহিলেন, “হিন্দুঘরের মেয়ের উপযুক্ত বয়সে বিবাহ করে গৃহধর্ম পালন করাই সকলের চেয়ে বড়ো ধর্ম কি না।”

 গোরা কিছু ক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “দেখুন, আপনি এ-সমস্ত ব্যাপারে আমাকে জড়াবেন না। বিধান দেবার পণ্ডিত আমি নই।”

 হরিমোহিনী তখন একটু তীব্রভাবে কহিলেন, “তোমার মনের ভিতরকার ইচ্ছাটা তা হলে খুলেই বলো-না। গোড়াতে ফাঁস জড়িয়েছ তুমিই, এখন খোলবার বেলায় বল ‘আমাকে জড়াবেন না।’ এর মানেটা কী! আসল কথা, ইচ্ছেটা তোমার নয় যে ওর মন পরিষ্কার হয়ে যায়।”

 অন্য কোনো সময় হইলে গোরা আগুন হইয়া উঠিত। এমনতরো সত্য অপবাদও সে সহ্য করিতে পারিত না। কিন্তু আজ তাহার প্রায়শ্চিত্ত আরম্ভ হইয়াছে, সে রাগ করিল না। সে মনের মধ্যে তলাইয়া দেখিল, হরিমোহিনী সত্য কথাই বলিতেছেন। সে সুচরিতার সঙ্গে বড়ো বাঁধনটা কাটিয়া ফেলিবার জন্য নির্মম হইয়া উঠিয়াছে, কিন্তু একটি সূক্ষ্ম সূত্র, যেন দেখিতে পাই নাই এমনি ছল করিয়া, সে রাখিতে চায়। সে সুচরিতার সহিত সম্বন্ধকে একেবারে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করিয়া দিতে এখনো পারে নাই।

 কিন্তু কৃপণতা ঘুচাইতে হইবে। এক হাত দিয়া দান করিয়া আর-এক হাত দিয়া ধরিয়া রাখিলে চলিবে না।

 সে তখন কাগজ বাহির করিয়া জোরের সঙ্গে বড় অক্ষরে লিখিল-‘বিবাহই নারীর জীবনে সাধনার পথ, গৃহধর্মই তাহার প্রধান ধর্ম। এই বিবাহ ইচ্ছাপূরণের জন্য নহে, কল্যাণসাধনের জন্য। সংসার সুখেরই হউক আর দুঃখেরই হউক, একমনে সেই সংসারকেই বরণ করিয়া, সতী সাধ্বী

৫৭৬