পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৪

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 গোরা ছাতে আসিয়া মুহূর্তের এক অংশ কাল বিনয়ের মুখের দিকে চাহিয়া আর যেন তাহাকে দেখিতেই পাইল না। পরেশকে নমস্কার করিয়া সে অসংকোচে একটা চৌকি টেবিল হইতে কিছু দূরে সরাইয়া লইয়া বসিল। মেয়েরা যে এখানে কোনো এক জায়গায় আছে তাহা লক্ষ্য করা সে অশিষ্টতা বলিয়া গণ্য করিল।

 বরদাসুন্দরী এই অসভ্যের নিকট হইতে মেয়েদিগকে লইয়া চলিয়া যাইবেন স্থির করিতেছিলেন, এমন সময় পরেশ তাঁহাকে কহিলেন, “এর নাম গৌরমোহন, আমার বন্ধু কৃষ্ণদয়ালের ছেলে।”

 তখন গোরা তাঁহার দিকে ফিরিয়া নমস্কার করিল। যদিও বিনয়ের সঙ্গে আলোচনায় সুচরিতা গোরার কথা পূর্বেই শুনিয়াছিল, তবু এই অভ্যাগতটি যে বিনয়ের বন্ধু, তাহা সে বুঝে নাই। প্রথম দৃষ্টিতেই গোরার প্রতি তাহার একটা আক্রোশ জন্মিল। ইংরেজি-শেখা কোনো লোকের মধ্যে গোঁড়া হিঁদুয়ানি দেখিলে সহ্য করিতে পারে, সুচরিতার সেরূপ সংস্কার ও সহিষ্ণুতা ছিল না।

 পরেশ গোরার কাছে তাহার বাল্যবন্ধু কৃষ্ণদয়ালের খবর লইলেন, তাহার পরে নিজেদের ছাত্র-অবস্থার কথা আলোচনা করিয়া বলিলেন, “তখনকার দিনে কলেজে আমরা দুজনেই এক জুড়ি ছিলুম, দুজনেই মস্ত কালাপাহাড়— কিছুই মানতুম না – হোটেলে খাওয়াটাই একটা কর্তব্য কর্ম বলে মনে করতুম। দুজনে কতদিন সন্ধ্যার সময়ে গোলদিঘিতে বসে মুসলমান দোকানের কাবাব খেয়ে, তার পরে কিরকম করে আমরা হিন্দুসমাজের সংস্কার করব, রাতদুপুর পর্যন্ত তারই আলোচনা করতুম।”

 বরদাসুন্দরী জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন তিনি কী করেন?

 গোরা কহিল, “এখন তিনি হিন্দু-আচার পালন করেন।”

 বরদা কহিলেন, “লজ্জা করে না?”

 রাগে তাঁহার সর্বাঙ্গ জ্বলিতেছিল।

 গোরা একটু হাসিয়া কহিল, “লজ্জা করাটা দুর্বল স্বভাবের লক্ষণ। কেউ

৬৪