মাঝখানে অনাহূত আসিয়া বিরুদ্ধ মত এমন অসংকোচে প্রকাশ করিয়া যাইতেছে, ইহাতে বিনয়কে পীড়া দিতে লাগিল। গোরার এইপ্রকার যুদ্ধোদ্যত আচরণের সহিত তুলনা করিয়া বৃদ্ধ পরেশের একটি আত্মসমাহিত প্রশান্ত ভাব, সকল প্রকার তর্কবিতর্কের অতীত একটি গভীর প্রসন্নতা, বিনয়ের হৃদয়কে ভক্তিতে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল। সে মনে মনে বলিতে লাগিল— ‘মতামত কিছুই নয়, অন্তঃকরণের মধ্যে পূর্ণতা স্তব্ধতা ও আত্মপ্রসাদ ইহাই সকলের চেয়ে দুর্লভ। কথার মধ্যে কোন্টা সত্য কোন্টা মিথ্যা তাহা লইয়া যতই তর্ক কর না কেন প্রাপ্তির মধ্যে যেটা সত্য সেইটাই আসল।’ পরেশ সকল কথাবার্তার মধ্যে মধ্যে এক-একবার চোখ বুজিয়া নিজের অন্তরের মধ্যে তলাইয়া লইতেছিলেন— ইহা তাঁহার অভ্যাস- তাঁহার সেই-সময়কার অন্তর্নিবিষ্ট শান্ত মুখশ্রী বিনয় একদৃষ্টে দেখিতেছিল। গোরা যে এই বৃদ্ধের প্রতি ভক্তি অনুভব করিয়া নিজের বাক্য সংযত করিতেছিল না, ইহাতে বিনয় বড়োই আঘাত পাইতেছিল।
সুচরিতা কয়েক পেয়ালা চা তৈরি করিয়া পরেশের মুখের দিকে চাহিল। কাহাকে চা খাইতে অনুরোধ করিবে না-করিবে তাহা লইয়া তাহার মনে দ্বিধা হইতেছিল। বরদাসুন্দরী গোরার দিকে চাহিয়াই একেবারে বলিয়া বসিলেন, “আপনি এ-সমস্ত কিছু খাবেন না বুঝি?”
গোরা কহিল, “না।”
বরদা। কেন। জাত যাবে?
গোরা বলিল, “হাঁ।”
বরদা। আপনি জাত মানেন?
গোরা। জাত কি আমার নিজের তৈরি যে মানব না? সমাজকে যখন মানি তখন জাতও মানি।
বরদা। সমাজকে কি সব কথায় মানতেই হবে?
গোরা। না মানলে সমাজকে ভাঙা হয়।
বরদা। ভাঙলে দোষ কী।
৬৬