পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৭

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

দাঁড়াইল। সুচরিতা মনে মনে একটু হাসিল; বুঝিল, ললিতা তাহার প্রতি অভিমান করিয়াছে। আজ যে তাহার ললিতার সঙ্গে শুইবার কথা ছিল তাহা সে একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছে। কিন্তু, ‘ভুলিয়া গেছি’ বলিলে ললিতার কাছে অপরাধ ক্ষালন হয় না; কারণ, ভুলিতে পারাটাই সকলের চেয়ে গুরুতর অপরাধ। সে যে যথাসময়ে প্রতিশ্রুতি মনে করাইয়া দিবে তেমন মেয়ে নয়। এতক্ষণ সে শক্ত হইয়া বিছানায় পড়িয়াছিল— যতই সময় যাইতেছিল ততই তাহার অভিমান তীব্র হইয়া উঠিতেছিল। অবশেষে যখন নিতান্তই অসহ্য হইয়া উঠিল তখন সে বিছানা ছাড়িয়া কেবল নীরবে জানাইতে আসিল যে, ‘আমি এখনো জাগিয়া আছি।’

 সুচরিতা চৌকি ছাড়িয়া ধীরে ধীরে ললিতার কাছে আসিয়া তাহার গলা জড়াইয়া ধরিল; কহিল, “ললিতা, লক্ষ্মী ভাই, রাগ কোরো না ভাই।”

 ললিতা সুচরিতার হাত ছাড়াইয়া লইয়া কহিল, “না, রাগ কেন করব! তুমি বোসো-না।”

 সুচরিতা তাহার হাত টানিয়া লইয়া কহিল, “চলো ভাই, শুতে যাই।”

 ললিতা কোনো উত্তর না করিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অবশেষে সুচরিতা তাহাকে জোর করিয়া টানিয়া শোবার ঘরে লইয়া গেল।

 ললিতা রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “কেন তুমি এত দেরি করলে? জান এগারোটা বেজেছে? আমি সমস্ত ঘড়ি শুনেছি। এখনি তো তুমি ঘুমিয়ে পড়বে।”

 সুচরিতা ললিতাকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া কহিল, “আজ আমার অন্যায় হয়ে গেছে ভাই।”

 যেমনি অপরাধ স্বীকার করা ললিতার আর রাগ রহিল না। একেবারে নরম হইয়া কহিল, “এতক্ষণ একলা বসে কার কথা ভাবছিলে দিদি? পানুবাবুর কথা?”

 তাহাকে তর্জনী দিয়া আঘাত করিয়া সুচরিতা কহিল, “দূর!” পানুবাবুকে ললিতা সহিতে পারিত না। এমন-কি, তাহার অন্য বোনের মতো তাহাকে লইয়া সুচরিতাকে ঠাট্টা করাও তাহার পক্ষে অসাধ্য ছিল।

৭৭