পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৬

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 বিনয়। সব সময়ে নয়। কিন্তু দেখো গোরা, সমাজের সঙ্গে যেখানে হৃদয়ের সংঘাত বাধে সেখানে আমার পক্ষে—

 গোরা অধীর হইয়া উঠিয়া বিনয়কে কথাটা শেষ করিতেই দিল না। সে গর্জিয়া কহিল, “হৃদয়! সমাজকে তুমি ছোটো করে তুচ্ছ করে দেখ বলেই কথায় কথায় তোমার হৃদয়ের সংঘাত বাধে। কিন্তু সমাজকে আঘাত করলে তার বেদনা যে কতদূর পর্যন্ত গিয়ে পৌছয় তা যদি অনুভব করতে তা হলে তোমার ওই হৃদয়টার কথা তুলতে তোমার লজ্জা বোধ হত। পরেশবাবুর মেয়েদের মনে একটুখানি আঘাত দিতে তোমার ভারি কষ্ট লাগে— কিন্তু আমার কষ্ট লাগে, এতটুকুর জন্যে সমস্ত দেশকে যখন অনায়াসে আঘাত করতে পার।”

 বিনয় কহিল, “তবে সত্য কথা বলি ভাই গোরা। এক পেয়ালা চা খেলে সমস্ত দেশকে যদি আঘাত করা হয় তবে সে আঘাতে দেশের উপকার হবে। তার থেকে বাঁচিয়ে চললে দেশটাকে অত্যন্ত দুর্বল, বাবু করে তোলা। হবে।”

 গোরা। ওগো, মশায়, ও-সমস্ত যুক্তি আমি জানি— আমি যে একেবারে অবুঝ তা মনে কোরো না। কিন্তু এসমস্ত এখনকার কথা নয়। রুগি ছেলে যখন ওষুধ খেতে চায় না, মা তখন সুস্থ শরীরেও নিজে ওষুধ খেয়ে তাকে জানাতে চায় যে তোমার সঙ্গে আমার এক দশা— এটা তো যুক্তির কথা নয়, এটা ভালোবাসার কথা। এই ভালোবাসা না থাকলে যতই যুক্তি থাক-না, ছেলের সঙ্গে মায়ের যোগ নষ্ট হয়। তা হলে কাজও নষ্ট হয়। আমিও চায়ের পেয়ালা নিয়ে তর্ক করি না— কিন্তু দেশের সঙ্গে বিচ্ছেদ আমি সহ্য করতে পারি না— চা না খাওয়া তার চেয়ে ঢের সহজ— পরেশবাবুর মেয়ের মনে কষ্ট দেওয়া তার চেয়ে ঢের ছোটো। সমস্ত দেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মেলাই আমাদের এখনকার অবস্থায় সকলের চেয়ে প্রধান কাজ। যখন মিলন হয়ে যাবে তখন চা খাবে কি না-খাবে দু কথায় সে তর্কের মীমাংসা হয়ে যাবে।

৮৬