পাতা:চয়নিকা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৪
চয়নিকা

তরঙ্গবন্ধনে বাঁধি’, নীলাম্বর-অঞ্চলে তোমার
সযত্নে বেষ্টিয়া ধরি’ সন্তর্পণে দেহখানি তার
সুকোমল সুকৌশলে। এ কী সুগম্ভীর স্নেহখেলা
অম্বুনিধি, ছল করি দেখাইয়া মিথ্যা অবহেলা
ধীরি ধীরি পা টিপিয়া পিছু হটি’ চলে যাও দূরে,
যেন ছেড়ে যেতে চাও—আবার আনন্দপূর্ণ সুরে
উল্লসি’ ফিরিয়া আসি’ কল্লোলে ঝাঁপায়ে পড়ো বুকে,
রাশি রাশি শুভ্রহাস্যে, অশ্রুজলে স্নেহ-গর্বসুখে
আর্দ্র করি’ দিয়ে যাও ধরিত্রীর নির্মল ললাট
আশীর্বাদে। নিত্যবিগলিত তব অন্তর বিরাট,
আদি অন্ত স্নেহরাশি,—আদি অন্ত তাহার কোথা রে,
কোথা তার তল, কোথা কূল। বলো কে বুঝিতে পারে
তাহার অগাধ শান্তি, তাহার অপার ব্যাকুলতা,
তার সুগম্ভীর মৌন, তার সমুচ্ছল কলকথা,
তার হাস্য, তার অশ্রুরাশি।—কখনো বা আপনারে
রাখিতে পারো না যেন, স্নেহপূর্ণ স্ফীত স্তনভারে
উন্মাদিনী ছুটে এসে ধরণীরে বক্ষে ধরো চাপি’
নির্দয় আবেগে; ধরা প্রচণ্ড পীড়নে উঠে কাঁপি’,
রুদ্ধশ্বাসে ঊর্ধ্বশ্বাসে চীৎকারি’ উঠিতে চাহে কাঁদি’,
উন্মত্ত স্নেহক্ষুধায় রাক্ষসীর মতো তা’রে বাঁধি’,
পীড়িয়া নাড়িয়া যেন টুটিয়া ফেলিয়া একেবারে
অসীম অতৃপ্তি মাঝে গ্রাসিতে নাশিতে চাহ তা’রে
প্রকাণ্ড প্রলয়ে। পরক্ষণে মহা অপরাধী প্রায়
পড়ে থাকো তটতলে স্তব্ধ হয়ে বিষণ্ণ ব্যথায়
নিষণ্ণ নিশ্চল; ধীরে ধীরে প্রভাত উঠিয়া এসে
শান্তদৃষ্টি চাহে তোমাপানে; সন্ধ্যাসখি ভালোবেসে
স্নেহকরস্পর্শ দিয়ে সান্ত্বনা করিয়ে চুপে চুপে