গ্রামে আসিয়া, আপনার আত্মীয়কুটুম্ব, প্রতিবেশী ও বন্ধুবর্গের মধ্যেই সে অর্থ ব্যয় করিতেন। পরোক্ষভাবে দশে তাঁহাদের অর্থের ভাগী ও ভোগী হইত; সাক্ষাৎভাবে তাঁহারা তাঁহাদের প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠার দ্বারা সময়ে অসময়ে অনেক সাহায্যলাভ করিত। বিবাহ ও শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া-কর্ম্মে, দোলদুর্গোৎসবাদি নৈমিত্তিক পূজাপার্বণে, নিত্য দেবসেবা ও অতিথিসেবার ভিতর দিয়া, গ্রামের লোকের সঙ্গে তাঁহাদের একটা নিকট সম্বন্ধ জমাট হইয়া যাইত। আর এই জন্য, তাঁরা যেখানে যাইয়া দাড়াইতেন, শত শত লোকে সেখানে যাইয়া তাঁহাদের পৃষ্ঠপোষক হইয়া দাড়াইত। তাঁরা যে কাজ করিতে যাইতেন, সকলে সে কাজে রত হইত। তাঁরা যে পথ দেখাইতেন, সকলে বিনা ওজরে, বিনা বিচারে, সে পথ ধরিয়া চলিত। তখন দেশে সত্যকার লোক–নেতৃত্ব ছিল। ইঁহারাই সেকালে প্রকৃত লোক-নায়ক ছিলেন।
আর আজ——‘তে হি নো দিবসাঃ গতাঃ’। সে দিনও নাই—সে সমাজও নাই! লোকে লেখাপড়া শিখিয়া, যারা লেখা পড়া জানে না তাহাদের নিকট হইতে পৃথক্ হইয়া পড়ে। আমাদের দেশে ‘শিক্ষিত' ও 'অশিক্ষিতে’র, ‘বিজ্ঞে’র ও ‘অজ্ঞে’র মধ্যে এককালে এ সাংঘাতিক ব্যবধান ছিল না। গ্রামের বিদ্যাভূষণ বা তর্কসিদ্ধান্ত বা ন্যায়ালঙ্কার মহাশয়ের বাড়ীতে আপামর সাধারণ সকলের অবাধ গতিবিধি ছিল। তাঁর চতুষ্পাঠীতে, যখন তিনি শিষ্যমণ্ডলী-বেষ্টিত হইয়া ব্যাকরণ বা স্মৃতি বা ন্যায়ের অধ্যাপনা করাইতেন, তখনও গ্রামের চাষী ও ব্যবসায়ীরা তাঁর কাছে যাইয়া নীরবে বসিয়া থাকিত এবং তাঁর তামাকাদি সাজিয়া, তাঁর সেবাশুশ্রূষায় নিযুক্ত হইত। তাদের সঙ্গে তাঁর বিদ্যার ব্যবধান যাই থাকুক না কেন, প্রাণের ব্যবধান বড় বেশি ছিল না। আর এই একপ্রাণতা নিবন্ধন, দেশের আপামর সাধারণে এ সকল উদারচরিত ব্রাহ্মণের