হিন্দুর নিকটে ইহা গুণের কথা না হইয়া, অত্যন্ত দোষের কথাই হয়। হিন্দুর সাধনার একটা অতি মামুলী কথা আছে যে দেবতাদের উপদেশেরই অনুসরণ করিবে, কদাপি তাঁহাদের কর্ম্মের অনুকরণ করিবে না। আমাদের বিদেশীয় ভাবাপন্ন বিচারবুদ্ধি প্রায়ই এ কথাটাকে উপহাস্যাস্পদ বলিয়া উড়াইয়া দিতে চেষ্টা করে। কখনও কখনও ইহাকে অতিশয় হীন বাক্য বলিয়াও ঘৃণা করিয়া থাকে। ইংরেজি প্রবাদ বাক্যে বলে উপদেশ অপেক্ষা আচরণ শ্রেষ্ঠ। এই হিসাবে দেবতাদের আচরণ যদি ধর্ম্মবিগর্হিত হয়, তবে তাহাদের আদেশের বা উপদেশের কোনও মূল্য ও সত্য থাকে না। কিন্তু য়ুরোপীয় সাধনা আমাদের অধিকারীভেদ মানে না। অথচ এই অধিকারীভেদই হিন্দুর সাধনার মুখ্য কথা। আমাদের সকল সাধনভজন, কর্ম্মাকর্ম্ম, ধর্ম্মাধর্ম্ম, বিধিনিষেধাদি এই অধিকারীভেদের উপরে প্রতিষ্ঠিত। এইজন্যই দেবতার অধিকারে যা সাজে ও যাহা ধর্ম্ম, মানুষের তাহা সাজে না, মানুষের পক্ষে তাহা অধর্ম্ম, ঈশ্বরকে মানুষের আদর্শ করিলে, সমাজ ধর্ম্ম ও লোকধর্ম্ম সকলই উলট্পালট্ হইয়া যায়। হিন্দু একেশ্বরবাদী, আদ্বৈততত্ত্বের উপরে হিন্দুর সকল সিদ্ধান্তের ও সাধনার প্রতিষ্ঠা হইয়াছে। বিশিষ্টাদ্বৈত, শুদ্ধাদ্বৈত, দ্বৈতাদ্বৈত, বৈষ্ণব, বৈদান্তিক, শাক্ত, শৈব, সকল সিদ্ধান্তই কোনও না কোনও আকারে এই অদ্বৈততত্ত্বকে মানিয়াছেন। আর মূলতত্ত্ব এক বলিয়া, বিশ্বের বহুধা প্রকাশের বা অভিব্যক্তির মধ্যে আপাতত বিরোধ ও বৈষম্য যাই থাকুক না কেন, মূলে একটা সমন্বয় এবং সামঞ্জস্য আছেই আছে। একান্ত ভাল বা একান্ত মন্দ, একাত্ত পাপ বা একান্ত পুণ্য বলিয়া কোনও কিছু জগতে নাই। এক ক্ষেত্রে যাহা ভাল অন্য ক্ষেত্রে তাহাই মন্দ। এক অবস্থায় ও এক অধিকারে যাহা পাপ, অন্য অধিকারে তাহা পাপ নহে। এ সকল কথা হিন্দু সাধনার গোড়ার কথা, সুতরাং মানুষের চক্ষে ও মানুষের
পাতা:চরিত-কথা - বিপিনচন্দ্র পাল (১৯১৬).pdf/৮৯
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৪
চরিত-কথা