পাতা:চিঠিপত্র (দশম খণ্ড)-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ...তাঁহার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশিবার পর অন্য সমস্ত প্রসঙ্গ ছায়ার ন্যায় মন হইতে চলিয়া যায়, এবং ছবির মতো তিনি সমগ্র মনটি দখল করিয়া বসেন। কতদিন আমার ন্যায় শ্রোতার সম্মুখে সারাটিদিন বীণা-নিন্দিত সুরে তিনি গান গাহিয়া কাটাইয়াছেন— কতদিন সাহিত্যধর্মসমাজ —নীতি সম্বন্ধে আলোচনা চলিয়াছে— তিনি নিত্যই নূতন হইয়া দেখা দিয়াছেন।

 ...আমার সঙ্গে পরিচয়ের পর তিনি ‘চোখের বালি’ লিখিতে শুরু করেন।[১]

 একবার তিনি আমাকে বোলপুরে যাইতে সাদর আহ্বান পাঠাইয়া লিখিয়াছিলেন “আপনি একবার আমার এলাকার মধ্যে আসিয়া পড়িলে তাহার পরে যে কাণ্ডটা করা যাইবে সে আমার মনেই আছে। তাই বলিয়া বিনোদিনীর রহস্য-নিকেতনে আপনাকে অকালে প্রবেশ করিতে দেওয়া আমার সম্পাদকধর্ম্মসঙ্গত হইবে কি না তাহা এখনো স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।”[২]

 কিন্তু চোখের বালি তিনি কিস্তিতে কিস্তিতে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হইবার পূর্বে আমাকে পড়িয়া শুনাইয়াছিলেন, বিনোদিনীর রহস্য-নিকেতনে আমাকে প্রবেশাধিকার দিয়াছিলেন। ‘গোরা’রও অনেকটা ছাপা হইবার পূর্বে আমি তাঁহার মুখে শুনিয়াছিলাম।

 ...আমি নৌকাডুবি, চোখের বালি, গোরা পড়ি নাই, রবিবাবুর মুখে শুনিয়াছিলাম, তেমন আগ্রহে ইহার পূর্বে কোনো বই শুনি নাই।

 ...রবীন্দ্রবাবুর সর্বাপেক্ষা চিত্তাকর্ষক গুণ তাঁহার ভগবৎপ্রীতি। ইহাই তাঁহার নৈবেদ্য, গীতাঞ্জলি, খেয়া প্রভৃতি কাব্যের ছত্রগুলিকে এত উজ্জ্বল করিয়াছে। এই ভগবৎ-প্রীতি তাঁহাকে মনুষ্যসমাজ হইতে স্বতন্ত্র করিয়া দেয় নাই, বরং সমস্ত মনুষ্যসমাজ, এমনকি প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর সঙ্গে তাঁহার নৈকট্য ঘনীভূত করিয়া আনন্দরসসিক্ত করিয়া দিয়াছে— ইহা শুধু তাঁহার কবিতার কথা নহে, ইহা শুধু প্রতিভার স্ফূরিত আকস্মিক আলো নহে— ইহা তাঁহার জীবনের কথা, তাঁহার সাধনা। তাঁহার বহু চিঠিপত্র আমার নিকট আছে; এই পত্রগুলিতে অনেকের মধ্যেই সেই সাধকের তপস্যা ব্যক্ত হইয়াছে। তাঁহার

  1. বঙ্গদর্শন, বৈশাখ ১৩০৮: গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৩০৯
  2. দ্র° রবীন্দ্রনাথ- লিখিত পত্র ৫

৭৬