বৈষ্ণব কবিতা বা গীতগোবিন্দের ভেতর যে-রস পরিবেশিত হয়েছে, তার নাম হলো শৃঙ্গার রস বা আদিরস। এই শৃঙ্গার রস বা আদিরসের অন্যতম চরম সার্থক প্রকাশ হলো গীতগোবিন্দ। গীতগোবিন্দের প্রত্যেক শ্লোক, শ্লোকের প্রত্যেক অক্ষর এই রসে টইটম্বুর হয়ে আছে। সমস্ত কাব্যের মধ্যে এমন কোন শ্লোক নেই, শ্লোকে এমন কোন পদ নেই, পদে এমন কোন অক্ষর নেই যা এই অমৃতরসে নিষিক্ত হয়নি। কবির প্রাণের উত্তাপে ভাষা গ’লে হয়ে গিয়েছে রস-নির্ঝরিণী, আদি-রসের নির্ঝরিণী।
আমরা সাধারণ ভাষায় যে-অর্থে রস, ভাব, প্রেম, মান, অভিমান ইত্যাদি কথা ব্যবহার করি, বৈষ্ণব-সাহিত্যে কিন্তু এই সব কথার একটা করে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সংজ্ঞা বা অর্থ আছে, যে সংজ্ঞার সঙ্গে পরিচিত না হলে বৈষ্ণব-কবিতার আসল স্বাদ পাওয়া সম্ভব নয়। অণু বা পরমাণু আমরা সাধারণ ভাষায় যে অর্থে ব্যবহার করি, বৈজ্ঞানিকের কাছে কিন্তু এই দুটী কথার তাৎপর্য্য তার অতিরিক্ত অনেক কিছু। বৈজ্ঞানিকের কাছে অণু বা পরমাণুর একটা রূপ আছে, সে-রূপের আঙ্কিক ব্যাখ্যা আছে, ওজন আছে, গতি আছে, তেজ আছে। ঠিক সেই রকম বৈষ্ণব-সাহিত্যে এমন কতকগুলি শব্দ প্রায়ই ব্যবহৃত হয়, রস-বিজ্ঞান-সম্মত যাদের একটা স্বতন্ত্র টেক্নিক্যাল তাৎপর্য্য আছে। এই শব্দ-তত্ত্বের সঙ্গে পরিচিত না হলে, বৈষ্ণব-সাহিত্য বোঝা সম্ভব নয়।
বৈষ্ণব-রস-শাস্ত্র অনুযায়ী শৃঙ্গার রসের একটা স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা আছে। শৃঙ্গ মানে হলো, সম্ভোগ করবার ইচ্ছার পূর্ণ জাগরণ। এই সম্ভোগ করবার বাসনা যাতে পরিতৃপ্ত হয়, তাকে বলে শৃঙ্গার রস। প্রত্যেক সুরের যেমন একটা রূপ আছে, রূপের অধিষ্ঠাতা দেবতা আছে, তেমনি রসেরও রূপ আছে এবং তার অধিষ্ঠাতা দেবতাও আছে। শৃঙ্গার রসের রূপ হলো শ্যামবর্ণ, তার অধিষ্ঠাতা দেবতা হলেন শ্রীকৃষ্ণ।
[দু’শ সত্তর]