পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৭
চোখের বালি

 দুই-তিনদিন সকল কর্মের মধ্যে এইরূপ উন্মনা হইয়া ফিরিয়া বিনোদিনী আর থাকিতে পারিল না। বিনোদিনী একখানি সান্ত্বনার পত্র লিখিল, কহিল—

 ঠাকুরপো, আমি তোমার লেনিকার সেই গুৰু মুখ দেখিয়া অবধি প্রাণমনে কামনা করিতেছি, তুমি স্থস্থ হও, তুমি যেমন ছিলে তেমনিটি হও— সেই সহজ হাসি আবার কবে দেখিব, সেই উদায় কৰ। আবার কৰে শুনিব। তুমি কেমন আছ, আমাকে একটি ছত্র লিখিয়া জানাও।

তোমার বিনোদ-বোঠান

 বিনোদিনী দরোয়ানের হাত দিয়া বিহারীর ঠিকানায় চিঠি পাঠাইয়া দিল।


 আশাকে বিহারী ভালোবাসে, এ কথা যে এমন রূঢ় করিয়া এমন গর্হিতভাবে মহেন্দ্র মুখে উচ্চারণ করিতে পারিবে, তাহা বিহারী স্বপ্নেও কল্পনা করে নাই। কারণ, সে নিজেও এমন কথা স্পষ্ট করিয়া কখনো মনে স্থান দেয় নাই। প্রথমটা জাহত হইল— তার পরে ক্রোধে ঘৃণায় ছটফট করিয়া বলিতে লাগিল, 'অন্যায়! অসংগত! অমূলক!'

 কিন্তু কথাটা যখন একবার উচ্চারিত হইয়াছে, তখন তাহাকে আর সম্পূর্ণ মারিয়া ফেলা যায় না। তাহার মধ্যে যেটুকু সত্যের বীজ ছিল, তাহ দেখিতে দেখিতে অঙ্কুরিত হইয়া উঠিতে লাগিল। কন্যা দেখিবার উপলক্ষে সেই যে একদিন সূর্যাস্তকালে বাগানের উচ্ছ্বসিত পুষ্পগন্ধপ্রবাহে লজ্জিত বালিকার হুকুমার মুখখানিকে সে নিতান্তই আপনার মনে করিয়া বিগলিত অম্বুরাগের সহিত একবার চাহিয়া দেখিয়াছিল, তাহাই বার বার মনে পড়িতে লাগিল, এবং বুকের কাছে কী যেন চাপিয়া ধরিতে লাগিল, এবং একটা অত্যন্ত কঠিন বেদনা কণ্ঠের কাছ পর্যন্ত আলোড়িত হইয়া উঠিল। দীর্ঘরাত্রি ছাদের উপর গুইয়া শুইয়া, বাড়ির সম্মুখের পথে দ্রুতপদে পায়চারি করিতে করিতে, যাহা এতদিন অব্যক্ত ছিল তাহা বিহারীর মনে ব্যক্ত হইয়া উঠিল। যাহা সংযত ছিল তাহা উদ্দাম হইল; নিজের কাছেও যাহার কোনো প্রমাণ ছিল না, মহেন্দ্রের বাক্যে তাহা বিরাট প্রাণ পাইয়া বিহারীর অন্তর-বাহির ব্যাপ্ত করিয়া দিল।

 তখন সে নিজেকে অপরাধী বলিয়া বুঝিল। মনে মনে কহিল, ‘আমার তো আর রাগ করা শোভা পায় না, মহেন্দ্রের কাছে তো ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া বিদায় লইতে হইবে। সেদিন এমনভাবে চলিয়া আসিয়াছিলাম,যেন মহেন্দ্র যোগী, আমি বিচারক- সে অন্যায় স্বীকার করিয়া আসিব।'