পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৮
চোখের বালি

 বিহারী জানিত, আশা কাশী চলিয়া গেছে। একদিন সে সন্ধ্যার সময় ধীরে ধীরে মহেন্দ্রের দ্বারের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজলক্ষ্মীর দূৱ-সম্পর্কের মামা সাধুচরণকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “সাধুদা, ক’দিন আসিতে পারি নাই— এখানকার সব খবর ভালো?”

 সাধুচরণ সকলেৱ কুশল জানাইল। বিহারী জিজ্ঞাসা করিল, “বোঠান কাশীতে কবে গেলেন।”

 সাধুচরণ কহিল, “তিনি যান নাই। তাহার কাশী যাওয়া হইবে না।”

 শুনিয়া, কিছু না মানিয়া অন্তঃপুরে যাইবার জন্য বিহারীর মন ছুটিল। পূর্বে যেমন সহজে, যেমন আনন্দে, আত্মীয়ের মতো সে পরিচিত সিঁড়ি বাহিয়া ভিতরে যাইত, সকলের সঙ্গে স্নিগ্ধ কৌতুকের সহিত হাস্যালাপ করিয়া আসিত, কিছুই মনে হইত না, আজ তাহা অবিহিত, তাহা দুর্লভ, জানিয়াই তাহার চিত্ত যেন উন্মত্ত হুইল। আর-একটিবার, কেবল শেষবার, তেমনি করিয়া ভিতরে গিয়া ঘরের ছেলের মতে রাজলক্ষ্মীর সহিত কথা সারিয়া, একবার ঘোমটাৰ্বত আশাকে ‘বোঠান বলিয়া দুটো তুচ্ছ কথা কহিয়া আসা তাহার কাছে পরম আকাঙ্ক্ষার বিষয় হইয়া উঠিল।

 সাধুচরণ কহিল, “ভাই, অন্ধকারে দাড়াইয়া রহিলে যে, ভিতরে চলো।”

 শুনিয়া বিহারী দ্রুতবেগে ভিতরের দিকে কয়েক পদ অগ্রসর হইয়াই ফিরিয়া সাধুকে কহিল, “যাই, একটা কাজ আছে।”

 বলিয়া তাড়াতাড়ি প্রস্থান করিল।

 সেই রাত্রেই বিহারী পশ্চিমে চলিয়া গেল।

 দারোয়ান বিনোদিনীর চিঠি লইয়া বিহারীকে না পাইয়া চিঠি ফিরাইয়া লইয়া আসিল। মহেন্দ্র তখন দেউড়ির সম্মুখে ছোটো বাগানটিতে বেড়াইতেছিল। জিজ্ঞাসা করিল, “এ কাহার চিঠি।”

 দারোয়ান সমস্ত বলিল। মহেন্দ্র চিঠিখানি নিজে লইল।

 একবার সে ভাবিল, চিঠিখান লইয়া বিনোদিনীর হাতে দিবে— অপরাধিনী বিনোদিনীর লজ্জিত মুখ একবার সে দেখিয়া আসিবে, কোনো কথা বলিবে না। এই চিঠির মধ্যে বিনোদিনীর লজ্জার কারণ যে আছেই, মহেন্দ্রের মনে তাহাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। মনে পড়িল, পূর্বে আর-একদিন বিহারীর নামে এমনি একখানা চিঠি গিয়াছিল। চিঠিতে কী লেখা আছে, এ কথা না জানিয়া মহেন্দ্র