পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



২৬

 এক দিকে চন্দ্র অস্ত যায়, আর-এক দিকে সূর্য উঠে। আশা চলিয়া গেল, কিন্তু মহেন্দ্রের ভাগ্যে এখনো বিনোদিনীর দেখা নাই। মহেন্দ্র ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়, মাঝে মাঝে ছুতা করিয়া সময়ে অসময়ে তাহার মার ঘরে আসিয়া উপস্থিত হয়, বিনোদিনী কেবলই ফাঁকি দিয়া পালায়, ধরা দেয় না।

 রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের এইরূপ অত্যন্ত শূন্যভাব দেখিয়া ভাবিলেন, ‘বউ গিয়াছে, তাই এ বাড়িতে মহিমের কিছুই আর ভালো লাগিতেছে না।’

 আজকাল মহেন্দ্রের স্বখছঃখের পক্ষে মা যে বউয়ের তুলনায় একান্ত অনাবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে, তাহা মনে করিয়া তাহাকে বিধিল; তবু মহেন্দ্রের এই লক্ষ্মীছাড়া বিমর্ষ ভাব দেখিয়া তিনি বেদনা পাইলেন।

 বিনোদিনীকে ডাকিয়া বলিলেন, “সেই ইনফ্লুয়েঞ্জার পর হইতে আমার হাঁপানির মতো হইয়াছে; আমি তো আজকাল সিড়ি ভাঙিয়া ঘন ঘন উপরে যাইতে পারি না। তোমাকে বাছা, নিজে থাকিয়া মহিমের খাওয়া-দাওয়ার সমস্তই দেখিতে হইবে। বরাবরকার অভ্যাস, একজন কেহ যত্ন না করিলে মহিম থাকিতে পারে না। দেখো-না, বউ যাওয়ার পর হইতে ও কেমন একরকম হইয়া গেছে। বউকেও ধন্য বলি, কেমন করিয়া গেল।”

 বিনোদিনী একটুখানি মুখ বাকাইয়া বিছানার চাদর খুঁটিতে লাগিল। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কী বউ, কী ভাবিতেছ। ইহাতে ভাবিবার কথা কিছু নাই। যে যাহা বলে বলুক, তুমি আমাদের পর নও।”

 বিনোদিনী কহিল, “কাজ নাই, মা।”

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আচ্ছা, তবে কাজ নাই। দেখি, আমি নিজে যা পারি তাই করিব।”

 বলিয়া তখনই তিনি মহেন্দ্রের তেতলার ঘর ঠিক করিবার জন্য উদ্যত হইলেন। বিনোদিনী ব্যস্ত হইয়া কহিল, “তোমার অসুস্থ শরীর, তুমি যাইয়ো না, আমি যাইতেছি। আমাকে মাপ করো পিসিমা, তুমি যেমন আদেশ করিবে আমি তাহাই করিব।”

 রাজলক্ষ্মী লোকের কথা একেবারেই তুচ্ছ করিতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর হইতে সংসারে এবং সমাজে তিনি মহেন্দ্র ছাড়া আর-কিছুই জানিতেন না। মহেন্দ্র সম্বন্ধে বিনোদিনী সমাজনিন্দার আভাস দেওয়াতে তিনি বিরক্ত হইয়াছিলেন।