যাহার নিপুণ হস্তের শিল্প, তাহারই কোমল চম্পক-অঙ্গুলির যেন গন্ধ পাতা যাইতেছে।
এমন সময় দাসী রুপার রেকাবিতে ফল ও মিষ্ট এবং কাঁচের গ্লাসে বরফ দেওয়া আনারসের শরবত আনিয়া দিল। এ-সমস্তই পূর্বপ্রথা হইতে কিছু বিভিন্ন এবং বহু যত্ন ও পারিপাট্যের সহিত রচিত। সমস্ত স্বাদে গন্ধে দৃশ্যে নৃতনত্ব আসিয়া মহেন্দ্রের ইন্দ্রিয়সকল আবিষ্ট করিয়া তুলিল।
তৃপ্তিপূর্বক ভোজন সমাধা হইলে, রুপার বাটায় পান ও মসলা লইয়া বিনোদিনী ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করিল। হাসিতে হাসিতে কহিল, “এ-কয়দিন তোমার খাবার সময় হাজির হইতে পারি নাই, মাপ করিয়ো ঠাকুরপো। আর যাই করো, আমার মাথার দিব্য বহিল, তোমাৱ অযত্ন হইতেছে, এ খবরটা আমার চোখের বালিকে দিয়ো না। আমার যথাসাধ্য আমি করিতেছি—কিন্তু কী করিব ভাই, সংসারের সমস্ত কাজই আমার ঘাড়ে।”
এই বলিয়া বিনোদিনী পানের বাটা মহেন্দ্রের সম্মুখে অগ্রসর করিয়া দিল। আজিকার পানের মধ্যেও কেয়া-খয়েরের একটু বিশেষ নূতন গন্ধ পাওয়া গেল।
মহেন্দ্র কহিল, “যত্নের মাঝে মাঝে এমন এক-একটা ত্রুটি থাকাই ভালো।”
বিনোদিনী কহিল, “ভালো কেন শুনি।”
মহেন্দ্র উত্তর করিল, “তার পরে খোঁটা দিয়া সুদযুদ্ধ আদায় করা যায়।”
“মহাজন-মশায়, সুদ কত জমিল?”
মহেন্দ্র কহিল, “খাবার সময় হাজির ছিলে না, এখন খাবার পরে হাজির পোষাইয়া আরো পাওনা বাকি থাকিবে।”
“বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “তোমার হিসাব যে-রকম কড়াক্কড়, তোমার হাতে একবার পড়িলে আর উদ্ধার নাই দেখিতেছি।”
মহেন্দ্র কহিল, “হিসাবে যাই থাক, আদায় কি করিতে পারিলাম।”
বিনোদিনী কহিল, “আদায় করিবার মতো আছে কী। তবু তো বন্দী করিয়া রাখিয়াছ।”
বলিয়া ঠাট্টাকে হঠাৎ গাম্ভীর্যে পরিণত করিয়া ঈষৎ একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
মহেন্দ্রও একটু গম্ভীর হইয়া কহিল, “ভাই বালি, এটা কি তবে জেলখানা।”
এমন সময় বেহারা নিয়মমত আলো আনিয়া টিপাইয়ের উপর রাখিয়া চলিয়া গেল।