পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১০
চোখের বালি

 তুমি আর কত দেরি করিবে। তোমার জেঠামহাশয় যদি শীঘ্র ফিরিবার কথা না থাকে, তবে আমাকে লিখিয়ো, আমি নিজে গিয়া তোমাকে লইয়া আসিব। এখানে একলা আমার ভালো লাগিতেছে না।

২৭

মহেন্দ্রের চলিয়া যাওয়ার কিছুদিন পরেই আশা যখন কাশীতে আসিল, তখন অন্নপূর্ণার মনে বড়োই আশঙ্কা জন্মিল। আশাকে তিনি নানা প্রকারে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, “হাঁ রে চুনি, তুই যে তোর সেই চোখের বালির কথা বলিতেছিলি, তোর মতে তার মতন এমন গুণবতী মেয়ে আর জগতে নাই!”

 “সত্যই মাসি, আমি বাড়াইয়া বলিতেছি না। তার যেমন বুদ্ধি তেমনি রূপ, কাজকর্মে তার তেমনি হাত।”

 “তোর সখী, তুই তো তাহাকে সর্বগুণবতী দেখিবি, বাড়ির আর-সকলে তাহাকে কে কী বলে শুনি।”

 “মার মুখে তো তার প্রশংসা ধরে না। চোখের বালি দেশে যাইবার কথা বলিলেই তিনি অস্থির হইয়া ওঠেন। এমন সেবা করিতে কেহ জানে না। বাড়ির চাকর-দাসীরও যদি কারো ব্যামো হয় তাকে বোনের মতো, মার মতো যত্ন করে।”

 “মহেন্দ্রের মত কী!”

 “তাঁকে তো জানই মাসি, নিতান্ত ঘরের লোক ছাড়া আর-কাউকে তার পছন্দই হয় না। আমার বালিকে সকলেই ভালোবাসে কিন্তু তাঁর সঙ্গে তার আজ পর্যন্ত ভালো বনে নাই।”

 “কিরকম!*

 “আমি যদি-বা অনেক করিয়া দেখাসাক্ষাৎ করাইয়া দিলাম, তাঁর সঙ্গে তার কথাবার্তাই প্রায় বন্ধ। তুমি তো জান তিনি কিরকম কুনো — লোকে মনে করে তিনি অহংকারী। কিন্তু তা নয় মাসি, তিনি দুটি-একটি লোক ছাড়া কাহাকেও সহ করিতে পারেন না।”

 শেষ কথাটা বলিয়া ফেলিয়া হঠাৎ আশার লজ্জাবোধ হইল, গাল-দুটি লাল হইয়া উঠিল। অন্নপূর্ণা খুশি হইয়া মনে মনে হাসিলেন; কহিলেন, “তাই বটে, সেদিন মহিম যখন আসিয়াছিল, তোর বালির কথা একবার মুখেও আনে নাই।”