পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১১১

 আশা দুঃখিত হইয়া কছিল, “ঐ তাঁর দোষ। যাকে ভালোবাসেন না, সে যেন একেবারে নাই। তাকে যেন একদিনও দেখেন নাই, জানেন নাই, এমনি তাঁর ভাব”

 অন্নপূর্ণা শান্ত স্নিগ্ধ হাস্য় কহিলেন, “আবার যাকে ভালোবাসেন মহিম যেন জন্মজন্মান্তর কেবল তাকেই দেখেন এবং জানেন, এ ভাবও তাঁর আছে। কী বলিস চুনি।”

 আশা তাহার কোনো উত্তর না করিয়া চোখ নিচু করিয়া হাসিল।

 অন্নপূর্ণা জিজ্ঞাসা করিলেন, “চুনি, বিহারীর কী খবর বল দেখি। সে কি বিবাহ করিবে না।”

 মুহূর্তের মধ্যেই আশার মুখ গভীর হইয়া গেল। সে কী উত্তর দিবে ভাবিয়া পাইল না।

 আশার নিরুত্তর ভাবে অত্যন্ত ভয় পাইয়া অন্নপূর্ণা বলিয়া উঠিলেন, “সত্য বল চুনি― বিহারীর অসুখ-বিসুখ কিছু হয় নি তো?”

 বিহারী এই চিরপুত্রহীনা রমণীর স্নেহ-সিংহাসনে পুত্রের মানস-আদৰ্শরূপে বিরাজ করিত। বিহারীকে তিনি সংসারে প্রতিষ্ঠিত দেখিয়া আসিতে পারেন নাই, এ দুঃখ প্রবাসে আসিয়া প্রতিদিন তাঁহার মনে জাগিত। তাঁহার ক্ষুদ্র সংসারের আর-সমস্তই একপ্রকার সম্পূর্ণ হইয়াছে, কেবল বিহারীর সেই গৃহহীন অবস্থা স্মরণ করিয়াই তাঁহার পরিপূর্ণ বৈরাগ্যচর্চার ব্যাঘাত ঘটে।

 আশা কহিল, “মাসি, বিহারী-ঠাকুরপোর কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়ো না।”

 অন্নপূর্ণা আশ্চর্ষ হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন বল দেখি।”

 আশা কহিল, “সে আমি বলিতে পারিব না।”

 বলিয়া ঘর হইতে উঠিয়া গেল।

 অন্নপূর্ণা চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন, ‘অমন সোনার ছেলে বেহারি, এরই মধ্যে তাহার কি এতই বদল হইয়াছে যে, চুনি আজ তাহার নাম শুনিয়া উঠিয়া যায়। অদৃষ্টেরই খেলা। কেন তাহার সহিত চুনির বিবাহের কথা হইল, কেনই-বা মহেন্দ্র তাহার হাতের কাছ হইতে চুনিকে কাড়িয়া লইল।’

 অনেক দিন পরে আজ আবার অন্নপূর্ণার চোখ দিয়া জল পড়িল; মনে মনে তিনি কহিলেন, ‘আহা, আমার বেহারি যদি এমন-কিছু করিয়া থাকে যাহা আমার বেহারির যোগ্য নহে, তবে সে তাহা অনেক দুঃখ পাইয়াই করিয়াছে, সহজে করে নাই।”