পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১২
চোখের বালি

 বিহারীর সেই দুঃখের পরিমাণ কল্পনা করিয়া অন্নপূর্ণার বক্ষ ব্যথিত হইতে লাগিল।

 সন্ধ্যার সময় যখন অন্নপূর্ণা আহ্নিকে বসিয়াছেন, তখন একটা গাড়ি আসিয়া দরজায় থামিল, এবং সহিল বাড়ির লোককে ভাকিয়া রুদ্ধ দ্বারে ঘা মারিতে লাগিল। অন্নপূর্ণা পূজাগৃহ হইতে বলিয়া উঠিলেন, “ঐ যা! আমি একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছিলাম, আজ কুঞ্জর শাশুড়ির এবং তার দুই বোনঝির এলাহাবাদ হইতে আসিবার কথা ছিল। ঐ বুঝি তাহারা আসিল। চুনি, তুই একবার আলোটা লইয়া দরজা খুলিয়া দে।”

 আশা লণ্ঠন হাতে দরজা খুলিয়া দিতেই দেখিল, বিহারী দাড়াইয়া। বিহারী বলিয়া উঠিল, “এ কী বোঠান, তবে যে শুনিলাম, তুমি কাশী আসিবে না।”

 আশার হাত হইতে লণ্ঠন পড়িয়া গেল। সে যেন প্রেতমূর্তি দেখিয়া এক নিশ্বাসে দোতলায় গিয়া আর্তস্বরে বলিয়া উঠিল, “মাসিম, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, উহাকে এখনই যাইতে বলো।”

 অন্নপূর্ণা পূজার আসন হইতে চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, “কাহাকে চুনি, কাহাকে।”

 আশা কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো এখানেও আসিয়াছেন।”

 বলিয়া সে পাশের ঘরে গিয়া দ্বার রোধ করিল।

 বিহারী নীচে হইতে সকল কথাই শুনিতে পাইল। সে তখনই ছুটিয়া যাইতে উদ্যত— কিন্তু অন্নপূর্ণা পূজাহ্নিক ফেলিয়া যখন নামিয়া আসিলেন তখন দেখিলেন, বিহারী দ্বারের কাছে মাটিতে বসিয়া পড়িয়াছে, তাহার শরীর হইতে সমস্ত শক্তি চলিয়া গেছে।

 অন্নপূর্ণা আলো জানেন নাই। অন্ধকারে তিনি বিহারীর মুখের ভাব দেখিতে পাইলেন না, বিহারীও তাহাকে দেখিতে পাইল না।

 অন্নপূর্ণা কহিলেন, “বেহারি!”

 হায়, সেই চিরদিনের স্নেহসুধাসিক্ত কণ্ঠস্বর কোথায়। এ কণ্ঠের মধ্যে যে কঠিন বিচারের বজ্রধ্বনি প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে! জননী অন্নপূর্ণ সংহারখড়্গ তুলিলে কার ’পরে। ভাগ্যহীন বিহারী যে আজ অন্ধকারে তোমার মঙ্গলচরণাশ্রয়ে মাথা রাখিতে আসিয়াছিল।

 বিহারীর অবশ শরীর আপাদমস্তক বিদ্যুতের আঘাতে চকিত হইয়া উঠিল; কহিল, “কাকীমা, আর নয়, আর একটি কথাও বলিয়ো না। আমি চলিলাম।”