পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১৬
চোখের বালি

উঠিল। এখন তাহার ঔদার্ধের সময় নহে। সে একটু হাসিয়া কহিল, “ঠাকুরঘরে কলা খাইবার যে গল্প আছে, তােমার ঠিক তাই দেখিতেছি। তােমাকে দোষ স্বীকার করিতেও বলি নাই, অস্বীকার করিতেও বলি নাই; তবে ক্ষমা চাহিয়া সাধু হইতে আসিয়াছ কেন?”

 বিহারী কাঠের পুতুলের মতাে কিছুক্ষণ আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল— তার পরে যখন কথা বলিবার প্রবল চেষ্টায় তাহার ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল তখন বিনােদিনী বলিয়া উঠিল, “বিহারী-ঠাকুরপাে, তুমি কোন উত্তর দিয়ো না। কিছুই বলিয়াে না। ঐ লােকটি যাহা মুখে আনিল তাহাতে উহারই মুখে কলঙ্ক লাগিয়া রহিল, সে ফল তােমাকে স্পর্শ করে নাই।”

 বিনােদিনীর কথা বিহারীর কানে প্রবেশ করিল কি না সন্দেহ— সে যেন স্বপ্নচালিতের মতাে মহেন্দ্রের ঘরের সম্মুখ হইতে ফিরিয়া সিঁড়ি দিয়া নামিয়া যাইতে লাগিল।

 বিনােদিনী তাহার পশ্চাতে গিয়া কহিল, “বিহারী- ঠাকুরপাে, আমাকে কি তােমার কোনাে কথা বলিবার নাই। যদি তিরস্কারের কিছু থাকে, তবে তিরস্কার করো।”

 বিহারী যখন কোনো উত্তর না করিয়া চলিতে লাগিল, বিনােদিনী সম্মুখে আসিয়া দুই হাতে তাহার দক্ষিণ হাত চাপিয়া ধরিল। বিহারী অপরিসীম ঘৃণার সহিত তাহাকে ঠেলিয়া দিয়া চলিয়া গেল। সেই আঘাতে বিনোদিনী যে পড়িয়া গেল তাহা সে জানিতে পারিল না।

 পতনশব্দ শুনিয়া মহেন্দ্র ছুটিয়া আসিল। দেখিল, বিনোদিনীর বাম হাতের কনুইয়ের কাছে কাটিয়া রক্ত পড়িতেছে।

 মহেন্দ্র কহিল, “ইস, এ যে অনেকটা কাটিয়াছে!”

 বলিয়া তৎক্ষণাৎ নিজের পাতলা জামার খানিকটা টানিয়া ছিঁড়িয়া ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ বাঁধিতে প্রস্তুত হইল।

 বিনােদিনী তাড়াতাড়ি হাত সরাইয়া লইয়া কহিল, “না না, কিছুই করিয়াে না, রক্ত পড়িতে দাও।”

 মহেন্দ্র কহিল, “বাঁধিয়া একটা ঔষধ দিতেছি, তাহা হইলে আর ব্যথা হইবে না, শীঘ্র সারিয়া যাইবে।”

 বিনোদিনী সরিয়া গিয়া কহিল, “আমি ব্যথা সারাইতে চাই না, এ কাটা আমার থাক্।”