পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২০
চোখের বালি

 মহেন্দ্র কহিল, “একটু রোসাে, আমি খাইয়া উঠিয়া তােমার সাহায্য করিতেছি।”

 বিনােদিনী জোড়হাত করিয়া কহিল, “দোহাই তােমার, আর যা কর সাহায্য করিয়াে না।”

 মহেন্দ্র খাইয়া উঠিয়া কহিল, “বটে! আমাকে অকর্মণ্য ঠাওরাইয়াছ! আচ্ছা, আজ আমার পরীক্ষা হউক।”

 বলিয়া কাপড় ভাঁজ করিবার বৃথা চেষ্টা করিতে লাগিল।

 বিনোদিনী মহেন্দ্রের হাত হইতে কাপড় কাড়িয়া লইয়া কহিল, “ওগাে মশায়, তুমি রাখাে, আমার কাজ বাড়াইয়াে না।”

 মহেন্দ্র কহিল, “তবে তুমি কাজ করিয়া যাও, আমি দেখিয়া শিক্ষালাভ করি।”

 বলিয়া আলমারির সম্মুখে বিনােদিনীর কাছে আসিয়া মাটিতে আসন করিয়া বসিল। বিনােদিনী কাপড় ঝাড়িবার ছলে একবার করিয়া মহেন্দ্রের পিঠের উপর আছড়াইয়া কাপড়গুলি পরিপাটিপূর্বক ভাঁজ করিয়া আলমারিতে তুলিতে লাগিল।

 আজিকার মিলন এমনি করিয়া আরম্ভ হইল। মহেন্দ্র প্রত্যুষ হইতে যেরূপ কল্পনা করিতেছিল, সেই অপূর্বতার কোন লক্ষণই নাই। এরূপভাবে মিলন কাব্যে লিখিবার, সংগীতে গাহিবার, উপন্যাসে রচিবার যােগ্য নহে। কিন্তু তবু মহেন্দ্র দুঃখিত হইল না, বরঞ্চ একটু আরাম পাইল। তাহার কাল্পনিক আদর্শকে কেমন করিয়া খাড়া করিয়া রাখিত, কিরূপ তাহার আয়ােজন, কী কথা বলিত, কী ভাব প্রকাশ করিতে হইত, সকলপ্রকার সামান্যতাকে কী উপায়ে দূরে রাখিত, তাহা মহেন্দ্র ঠাওরাইতে পারিতেছিল না– এই কাপড় ঝাড়া ও ভাঁজ করার মধ্যে হাসি-তামাশা করিয়া সে যেন স্বরচিত একটা অসম্ভব দুরূহ আদর্শের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া বাঁচিল।

 এমন সময় রাজলক্ষ্মী ঘরে প্রবেশ করিলেন। মহেন্দ্রকে কহিলেন, “মহিন, বউ কাপড় তুলিতেছে, তুই ওখানে বসিয়া কী করিতেছিস।”

 বিনোদিনী কহিল, “দেখাে তো পিসিমা, মিছামিছি কেবল আমার কাজে দেরি করাইয়া দিতেছেন।”

 মহেন্দ্র কহিল, “বিলক্ষণ! আমি আরাে ওঁর কাজে সাহায্য করিতেছিলাম।”

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার কপাল! তুই আবার সাহায্য করিবি! জান বউ, মহিনের বরাবর ঐরকম। চিরকাল মা-খুড়ির আদর পাইয়া, ও যদি কোনো কাজ নিজের হাতে করিতে পারে।”

 এই বলিয়া মাতা পরম স্নেহে কর্মে-অপটু মহেন্দ্রের প্রতি নেপাত করিলেন।