পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১২৩

শান্তিশতক আছে, অন্য বই রাখিয়া আজ সেইটে পড়িয়া শোনাও-না। পিসিমারও ভালো লাগিবে, সন্ধ্যাটাও কাটিবে ভালো।”

 মহেন্দ্র নিতান্ত করুণভাবে একবার বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিল। এমন সময় ঝি আসিয়া খবর দিল, “ম, কায়েত-ঠাকরুন আসিয়া তোমার ঘরে বসিয়া আছেন।”

 কায়েত-ঠাকরুন রাজলক্ষ্মীর অন্তরঙ্গ বন্ধু। সন্ধ্যার পর তাঁহার সঙ্গে গল্প করিবার প্রলোভন সংবরণ করা রাজলক্ষ্মীর পক্ষে দুঃসাধ্য। তবু ঝিকে বলিলেন, “কায়েত-ঠাকরুনকে বল, আজ মহিনের ঘরে আমার একটু কাজ আছে, কাল তিনি যেন অবশ্য-অবশ্য করিয়া আসেন।”

 মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কহিল, “কেন মা, তুমি তাণর সঙ্গে দেখা করিয়াই এসো-না।”

 বিনোদিনী কহিল, “কাজ কী পিসিম, তুমি এখানে থাকে, আমি বরঞ্চ কায়েত-ঠাকরুনের কাছে গিয়া বসি গে।”

 রাজলক্ষ্মী প্রলোভন সংবরণ করিতে না পারিয়া কহিলেন, “বউ, তুমি ততক্ষণ এখানে বোসো— দেখি, যদি কায়েত-ঠাকরুনকে বিদায় করিয়া আসিতে পারি। তোমরা পড়া আরম্ভ করিয়া দাও, আমার জন্য অপেক্ষা করিয়ো না।”

 রাজলক্ষ্মী ঘরের বাহির হইবা মাত্র মহেন্দ্র আর থাকিতে পারিল না; বলিয়া উঠিল, “কেন তুমি আমাকে ইচ্ছা করিয়া এমন করিয়া মিছামিছি পীড়ন কর।”

 বিনোদিনী যেন আশ্চর্য হইয়া কহিল, “সে কী ভাই। আমি তোমাকে পীড়ন কী করিলাম। তবে কী তোমার ঘরে আসা আমার দোষ হইয়াছে। কাজ নাই, আমি যাই।”

 বলিয়া বিমর্ষমুখে উঠবার উপক্রম করিল।

 মহেন্দ্র তাহার হাত ধরিয়া ফেলিয়া কহিল, “অমনি করিয়াই তো তুমি আমাকে দগ্ধ কর।”

 বিনোদিনী কহিল, “ইস, আমার যে এত তেজ, তাহা তো আমি জানিতাম না। তোমারও তো প্রাণ কঠিন কম নয়, অনেক সহ্য করিতে পার। খুব যে ঝলসিয়া-পুড়িয়া গেছ, চেহারা দেখিয়া তাহা কিছু বুঝিবার জো নাই।”

 মহেন্দ্র কহিল, “চেহারায় কী বুঝিবে।”

 বলিয়া বিনোদনীর হাত বলপূর্বক লইয়া নিজের বুকের উপর চাপিয়া ধরিল।

 বিনোদিনী “উঃ” বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিতেই মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়া দিয়া কহিল, “লাগিল কি।”