দেখিল, কাল বিনোদিনীর হাতের যেখানটা কাটিয়া গিয়াছিল সেইখান দিয়া আবার রক্ত পড়িতে লাগিল। মহেন্দ্র অনুতপ্ত হইয়া কহিল, “আমি ভুলিয়া গিয়াছিলাম— ভারি অন্যায় করিয়াছি। আজ কিন্তু এখনই তোমার ও জায়গাট বাঁধিয়া ওষুধ লাগাইয়া দিব— কিছুতেই ছাড়িব না।”
বিনোদিনী কহিল, “না, ও কিছুই না। আমি ওষুধ দিব না।”
মহেন্দ্র কহিল, “কেন দিবে না।”
বিনোদিনী কহিল, “কেন আবার কী। তোমার আর ডাক্তারি করিতে হইবে না, ও যেমন আছে থাক্।”
মহেন্দ্র মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হইয়া গেল; মনে মনে কহিল, ‘কিছুই বুঝিবার জো নাই। স্ত্রীলোকের মন!’
বিনোদিনী উঠিল। অভিমানী মহেন্দ্র বাধা না দিয়া কহিল, “কোথায় যাইতেছ।”
বিনোদিনী কহিল, “কাজ আছে।”
বলিয়া ধীরপদে চলিয়া গেল।
মিনিটখানেক বসিয়াই মহেন্দ্র বিনোদিনীকে ফিরাইয়া আনিবার জন্য দ্রুত উঠিয়া পড়িল; সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত গিয়াই ফিরিয়া আসিয়া একলা ছাদে বেড়াইতে লাগিল।
বিনোদিনী অহরহ আকর্ষণও করে, অথচ বিনোদিনী এক মুহূর্ত কাছে আসিতেও দেয় না। অন্যে তাহাকে জিনিতে পারে না, এ গর্ব মহেন্দ্রের ছিল, তাহা সে সম্প্রতি বিসর্জন দিয়াছে; কিন্তু চেষ্টা করিলেই অন্যকে সে জিনিতে পারে, এ গর্বটুকুও কি রাখিতে পারিবে না। আজ সে হার মানিল, অথচ হার মানাইতে পারিল না। হৃদয়ক্ষেত্রে মহেন্দ্রের মাথা বড়ো উচ্চেই ছিল, সে কাহাকেও আপনার সমকক্ষ বলিয়া জানিত না— আজ সেইখানেই তাহাকে ধুলায় মাথা লুটাইতে হইল। যে শ্রেষ্ঠতা হারাইল তাহার বদলে কিছু পাইলও না। ভিক্ষুকের মতো রুদ্ধদ্বারের সম্মুখে সন্ধ্যার সময় রিক্তহস্তে পথে দাঁড়াইয়া থাকিতে হইল।
ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বিহারীদের জমিদারি হইতে সর্ষেফুলের মধু আসিত, প্রতি বৎসরই সে তাহ রাজলক্ষ্মীকে পাঠাইয়া দিত— এবারও পাঠাইয়া দিল।
বিনোদিনী মধুভাণ্ড লইয়া স্বয়ং রাজলক্ষ্মীর কাছে গিয়া কহিল, “পিসিমা, বিহারী-ঠাকুরপো মধু পাঠাইয়াছেন।”
রাজলক্ষ্মী তাহা ভাঁড়ারে তুলিয়া রাখিতে উপদেশ দিলেন। বিনোদিনী মধু