পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৩১

 অন্নপূর্ণা ঈষৎ হাসিয়া কছিলেন, “আমার স্বামী এখন যাঁহার মধ্যে আছেন, সেই ভগবানের কথা ভাবি।”

 আশা কহিল, “তাহাতে তুমি সুখ পাও?”

 অন্নপূর্ণা সস্নেহে আশার মাথায় হাত বুলাইয়া কহিলেন, “আমার সে মনের কথা তুই কী বুঝিবি, বাছা। সে আমার মন জানে, আর যাঁর কথা ভাবি তিনিই জানেন।”

 আশা মনে মনে ভাবিতে লাগিল, “আমি যাঁর কথা রাত্রিদিন ভাবি, তিনি কি আমার মনের কথা জানেন না। আমি ভালো করিয়া চিঠি লিখিতে পারি না বলিয়া তিনি কেন আমাকে চিঠি লেখা ছাড়িয়া দিয়াছেন।”

 আশা কয়দিন মহেন্দ্রের চিঠি পায় নাই। নিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে সে ভাবিল, ‘চোখের বালি যদি হাতের কাছে থাকিত, সে আমার মনের কথা ঠিকমত করিয়া লিখিয়া দিতে পারিত।’

 কুলিখিত তুচ্ছ পত্র স্বামীর কাছে আদর পাইবে না মনে করিয়া চিঠি লিখিতে কিছুতে আশার হাত সরিত না। যতই যত্ন করিয়া লিখিতে চাহিত ততই তাহার অক্ষর খারাপ হইয়া যাইত। মনের কথা যতই ভালো করিয়া গুছাইয়া লইবার চেষ্টা করিত ততই তাহার পদ কোনোমতেই সম্পূর্ণ হইত না। যদি একটিমাত্র ‘শ্রীচরণেষু’ লিখিয়া নাম সহি করিলেই মহেন্দ্র অন্তর্যামী দেবতার মতো সকল কথা বুঝিতে পারিত, তাহা হইলেই আশার চিঠি লেখা সার্থক হইত। বিধাতা এতখানি ভালোবাসা দিয়াছেন, একটুখানি ভাষা দেন নাই কেন।

 মন্দিরে সন্ধ্যারতির পরে গৃহে ফিরিয়া আসিয়া আশা অন্নপূর্ণার পায়ের কাছে বসিয়া আস্তে আস্তে তাঁহার পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। অনেকক্ষণ নিঃশব্দের পর বলিল, “মাসি, তুমি যে বল, স্বামীকে দেবতার মতো করিয়া সেবা করা স্ত্রীর ধর্ম,—কিন্তু যে স্ত্রী মূর্খ, যাহার বুদ্ধি নাই, কেমন করিয়া স্বামীর সেবা করিতে হয় যে জানে না, সে কী করিবে।”

 অন্নপূর্ণা কিছুক্ষণ আশার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন; একটি চাপা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “বাছা, আমিও তো মূর্খ তবুও তো ভগবানের সেবা করিয়া থাকি।”

 আশা কছিল, “তিনি যে তোমার মন জানেন, তাই খুশি হন। কিন্তু মনে করো, স্বামী যদি মূর্খের সেবায় খুশি না হন?”

 অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সকলকে খুশি করিবার শক্তি সকলের থাকে না বাছা।