পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৪৩

 তখন ধোবা ডাকিতেছে, “মাঠাকরুন, কাপড় দিতে আর কত দেরি করিবে। বেলা অনেক হইল, আমার বাড়ি তো এখানে নয়।”


৩৪

রাজলক্ষ্মী আজ সকাল হইতে আর বিনোদিনীকে ডাকেন নাই। বিনোদিনী নিয়মমত ভাঁড়ারে গেল; দেখিল, রাজলক্ষ্মী মুখ তুলিয়া চাহিলেন না।

 সে তাহা লক্ষ্য করিয়াও বলিল, “পিসিমা, তোমার অসুখ করিয়াছে বুঝি? করিবারই কথা। কাল রাত্রে ঠাকুরপো যে কীর্তি করিলেন! একেবারে পাগলের মতো আসিয়া উপস্থিত। আমার তো তার পরে ঘুম হইল না।”

 রাজলক্ষ্মী মুখ ভার করিয়া রহিলেন; হাঁ, না, কোনো উত্তরই করিলেন না।

বিনোদিনী বলিল, “হয়তো চোখের বালির সঙ্গে সামান্ত কিছু খিটিমিটি হইয়া থাকিবে, আর দেখে কে। তখনই নালিশ কিংবা নিষ্পত্তির জন্যে আমাকে ধরিয়া লইয়া যাওয়া চাই, রাত পোহাইতে তর সয় না! যাই বল পিসিম, তুমি রাগ করিয়ো না, তোমার ছেলের সহস্র গুণ থাকিতে পারে, কিন্তু ধৈর্যের লেশমাত্র নাই। ঐজন্যই আমার সঙ্গে কেবলই ঝগড়া হয়।”

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “বউ, তুমি মিথ্যা বকিতেছ— আমার আজ আর কোনো কথা ভালো লাগিতেছে না!”

 বিনোদিনী কহিল, “আমারও কিছু ভালো লাগিতেছে না পিসিমা। তোমার মনে আঘাত লাগিবে, এই ভয়েই মিথ্যা কথা দিয়া তোমার ছেলের দোষ ঢাকিবার চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু এমন হইয়াছে যে, আর ঢাকা পড়ে না।”

 রাজলক্ষ্মী। আমার ছেলের দোষ-গুণ আমি জানি— কিন্তু তুমি যে কেমন মায়াবিনী, তাহা আমি জানিতাম না।

 বিনোদিনী কী একটা বলিবার জন্য উদ্যত হইয়া নিজেকে সংবরণ করিল; কহিল, “সে কথা ঠিক পিসিম, কেহ কাহাকেও জানে না। নিজের মনও কি সবাই জানে। তুমি কি কখনো তোমার বউয়ের উপর দ্বেষ করিয়া এই মায়াবিনীকে দিয়ৈ তোমার ছেলের মন ভুলাইতে চাও নাই। একবার ঠাওর করিয়া দেখো দেখি।”

 রাজলক্ষ্মী অগ্নির মতো উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিলেন; কহিলেন, “হতভাগিনী, ছেলের সম্বন্ধে মার নামে তুই এমন অপবাদ দিতে পারিস? তোর জিব খসিয়া পড়িবে না!”