পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪৬
চোখের বালি

তাহাকে ধরিয়া রাখিয়া কছিল, “তোমার ঘৃণাও আমাকে ফিরাইতে পারিবে না, আমি তোমাকে লইয়া যাইবই, এবং যেমন করিয়াই হউক, তুমি আমাকে ভালোবাসিবেই।”

 বিনোদিনী সকলে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইল।

 মহেন্দ্র কহিল, “চারি দিকে আগুন জ্বালাইয়া তুলিয়াছ; এখন আর নিবাইতেও পারিবে না, পালাইতেও পরিবে না।”

 বলিতে বলিতে মহেন্দ্রের গলা চড়িয়া উঠিল, উচ্চৈঃস্বরে সে কহিল, “এমন খেলা কেন খেলিলে বিনোদ। এখন আর ইহাকে খেলা বলিয়া মুক্তি পাইবে না। এখন তোমার আমার একই মৃত্যু।”

 রাজলক্ষ্মী ঘরে ঢুকিয়া কহিলেন, “মহিন, কী করছিস।”

 মহেন্দ্রের উন্মত্ত দৃষ্টি এক নিমেষমাত্র মাতার মুখের দিকে ঘুরিয়া আসিল; তাহার পর পুনরায় বিনোদিনীর দিকে চাহিয়া মহেন্দ্র কহিল, “আমি সব ছাড়িয়া চলিয়। যাইতেছি; বলো— তুমি আমার সঙ্গে যাইবে?”

 বিনোদিনী ক্রূদ্ধা রাজলক্ষ্মীর মুখের দিকে একবার চাহিল। তাহার পর অগ্রসর হইয়া অবিচলিত ভাবে মহেন্দ্রের হাত ধরিয়া কহিল, “যাইব।”

 মহেন্দ্র কহিল, “তবে আজকের মতো অপেক্ষা করো, আমি চলিলাম, কাল হইতে তুমি ছাড়া আমার আর কেহ রহিবে না।”

 বলিয়া মহেন্দ্র চলিয়া গেল।

 এমন সময় ধোবা আসিয়া বিনোদিনীকে কহিল, “মাঠাকরুন, আর তো বসিতে পারি না। আজ যদি তোমাদের ফুরসত না থাকে তো আমি কাল আসিয়া কাপড় লইয়া যাইব।”

 খেমি আসিয়া কহিল, “বউঠাকরুন, সহিস বলিতেছে দানা ফুরাইয়া গেছে।”

 বিনোদিনী সাত দিনের দানা ওজন করিয়া আস্তাবলে পাঠাইয়া দিত, এবং নিজে জানালায় দাঁড়াইয়া ঘোড়ার খাওয়া দেখিত।

 গোপাল-চাকর আলিয়া কহিল, “বউঠাকরুন, ঝড়ু-বেহারা আজ দাদামশায়ের (সাধুচরণের) সঙ্গে ঝগড়া করিয়াছে। সে বলিতেছে, তাহার কেরোসিনের হিসাব বুঝিয়া লইলেই সে সরকার-বাবুর কাছ হইতে বেতন চুকাইয়া লইয়া কাজ ছাড়িয়া দিয়া চলিয়া যাইবে।”

 সংসারের সমস্ত কর্মই পূর্ববৎ চলিতেছে।