পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫০
চোখের বালি

তখনো আমি জানিতাম। কিন্তু আশার মধ্যে তোমরা কী দেখিতে পাইয়াছ, আমি কিছুই বুঝিতে পারি না। ভালোই বল আর মন্দই বল, তাহার আছে কী। বিধাতা কি পুরুষের দৃষ্টির সঙ্গে অন্তর্দৃষ্টি কিছুই দেন নাই। তোমরা কী দেখিয়া, কতটুকু দেখিয়া ভোল। নির্বোধ! অন্ধ!

 বিহারী উঠিয়া দাঁড়াইয়া কছিল, “আজ তুমি আমাকে যাহা শুনাইবে সমস্তই আমি শুনিব— কিন্তু, যে কথা বলিবার নহে সে কথা বলিয়ে না, তোমার কাছে আমার এই একান্ত মিনতি।”

 বিনোদিনী। ঠাকুরপো, কোথায় তোমার ব্যথা লাগিতেছে, তাহা আমি জানি— কিন্তু যাহার শ্রদ্ধা আমি পাইয়াছিলাম এবং যাহার ভালোবাসা পাইলে আমার জীবন সার্থক হইত, তাহার কাছে এই রাত্রে ভয় লজ্জা সমস্ত বিসর্জন দিয়া ছুটির আসিলাম, সে যে কত বড়ো বেদনায় তাহা মনে করিয়া একটু ধৈর্য ধরো। আমি সত্যই বলিতেছি, তুমি যদি আশাকে ভালো না বাসিতে, তবে আমার দ্বারা আশার আজ এমন সর্বনাশ হইত না।

 বিহারী বিবর্ণ হইয়া কহিল, “আশার কী হইয়াছে। তুমি তাহার কী করিয়াছ।”

 বিনোদিনী। মহেন্দ্র তাহার সমস্ত সংসার পরিত্যাগ করিয়া কাল আমাকে লইয়া চলিয়া যাইতে প্রস্তুত হইয়াছে।

 বিহারী হঠাৎ গর্জন করিয়া উঠিল, “এ কিছুতেই হইতে পারে না। কোনোমতেই না।”

 বিনোদিনী। কোনোমতেই না? মহেন্দ্রকে আজ কে ঠেকাইতে পারে।

 বিহারী। তুমি পার।

 বিনোদিনী খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল; তার পরে বিহারীর মুখের দিকে দুই চক্ষু স্থির রাখিয়া কহিল, “ঠেকাইব কাহার জন্য। তোমার আশার জন্য? আমার নিজের সুখ দুঃখ কিছুই নাই? তোমার আশার ভালো হউক, মহেন্দ্রের সংসারের ভালো হউক, এই বলিয়া ইহকালের আমার সকল দাবি মুছিয়া ফেলিব, এত ভালো আমি নই— ধর্মশাস্ত্রের পুথি এত করিয়া আমি পড়ি নাই। আমি যাহা ছাড়িব তাহার বদলে আমি কী পাইব।”

 বিহারীর মুখের ভাব ক্রমশ অত্যন্ত কঠিন হইয়া আসিল; কহিল, “তুমি অনেক স্পষ্ট কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছ, এবার আমিও একটা স্পষ্ট কথা বলি। তুমি আজ যে কাণ্ডটা করিলে এবং যে কথাগুলা বলিতেছ, ইহার অধিকাংশই