পিতৃমাতৃহীনা বোনঝি আছে, এবং মহেন্দ্রের সহিত তাহার বিবাহ দিয়া সন্তানহীনা বিধবা কোনো সুত্রে আপনার ভগিনীর মেয়েটিকে কাছে আনিয়া সুখী দেখিতে চান। যদিচ বিবাহে সে নারাজ, তবু কাকীর এই মনোগত ইচ্ছাটি তাহার কাছে স্বাভাবিক এবং অত্যন্ত করুণাবহ বলিয়া মনে হইত।
মহেন্দ্র তাহার ঘরে যখন গেল তখন বেলা আর বড়ো বাকি নাই। কাকী অন্নপূর্ণা তাঁহার ঘরের কাটা জানালার গরাদের উপর মাথা রাখিয়া শুষ্ক বিমর্ষমুখে বসিয়া ছিলেন। পাশের ঘরে ভাত ঢাকা পড়িয়া আছে, এখনো স্পর্শ করেন নাই।
অল্প কারণেই মহেন্দ্রের চোখে জল আসিত। কাকীকে দেখিয়া তাহার চোখ ছল্ ছল্ করিয়া উঠিল। কাছে আসিয়া স্নিগ্ধস্বরে ডাকিল,“কাকীমা।”
অন্নপূর্ণা হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিলেন,“আয় মহিন, বোস্।”
মহেন্দ্র কহিল,“ভারি ক্ষুধা পাইয়াছে, প্রসাদ খাইতে চাই।”
অন্নপূর্ণা মহেন্দ্রের কৌশল বুঝিয়া উচ্ছসিত অশ্রু কষ্টে সম্বরণ করিলেন এবং নিজে খাইয়া মহেন্দ্রকে খাওয়াইলেন।
মহেন্দ্রের হৃদয় তখন করুণায় আর্দ্র ছিল। কাকীকে সান্তনা দিবার জন্য আহারান্তে হঠাৎ মনের ঝোঁকে বলিয়া বসিল,“কাকী, তোমার সেই-যে বোনঝির কথা বলিয়াছিলে তাহাকে একবার দেখাইবে না?”
কথাটা উচ্চাচরণ করিয়াই সে ভীত হইয়া পড়িল।
অন্নপূর্ণা হাসিয়া কহিলেন,“তোর আবার বিবাহে মন গেল নাকি মহিন।”
মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কহিল, “না,আমার জন্য নয় কাকী, আমি বিহারীকে রাজি করিয়াছি। তুমি দেখিবার দিন ঠিক করিয়া দাও।”
অন্নপূর্ণ কহিলেন, “আহা, তাহার কি এমন ভাগ্য হইবে। বিহারীর মতো ছেলে কি তাহার কপালে আছে।”
কাকীর ঘর হইতে বাহির হইয়া মহেন্দ্র দ্বারের কাছে আসিতেই মার সঙ্গে দেখা হইল। রাজলক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করিলেন,“কী মহেন্দ্র, এতক্ষণ তোদের কী পরামর্শ হইতেছিল।”
মহেন্দ্র কহিল,“পরামর্শ কিছুই না, পান লইতে আসিয়াছি।”
মা কহিলেন, “তোর পান তো আমার ঘরে সাজা আছে।”
মহেন্দ্র উত্তর না করিয়া চলিয়া গেল।
রাজলক্ষ্মী ঘরে ঢুকিয়া অন্নপূর্ণার রোদনস্ফীত চক্ষু দেখিবা মাত্র অনেক কথা