পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৫৭

আজ একা তারই জন্য যে ভোজ পাঠাইয়াছেন, হতভাগ্য কিসের দ্বিধায় তাহা হইতে নিজেকে বঞ্চিত করিবে।

 ছবি কোলে লইয়া এইরকম নানা কথা যখন সে একমনে আলোচনা করিতেছিল, এমন সময় পার্শ্বে শব্দ শুনিয়া চমকিয়া উঠিয়া দেখিল মহেন্দ্র আসিয়াছে। চকিত হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিতেই কোল হইতে ছবিখানি নীচে কার্পেটের উপর পড়িয়া গেল― বিহারী তাহা লক্ষ্য করিল না।

 মহেন্দ্র একেবারেই বলিয়া উঠিল, “বিনোদিনী কোথায়।”

 বিহারী মহেন্দ্রের কাছে অগ্রসর হইয়া তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “মহিনদা, একটু বোসো ভাই, সকল কথার আলোচনা করা যাইতেছে।”

 মহেন্দ্র কহিল, “আমার বসিবার এবং আলোচনা করিবার সময় নাই। বলো, বিনোদিনী কোথায়।”

 বিহারী কহিল, “তুমি যে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করিতেছ, এক কথায় তাহার উত্তর দেওয়া চলে না। একটু তোমাকে স্থির হইয়া বসিতে হইবে।”

 মহেন্দ্র কহিল, “উপদেশ দিবে? সে-সব উপদেশের কথা আমি শিশুকালেই পড়িয়াছি।”

 বিহারী। না, উপদেশ দিবার অধিকার ও ক্ষমতা আমার নাই।

 মহেন্দ্র। ভর্ৎসনা করিবে? আমি জানি আমি পাষণ্ড, আমি নরাধম, এবং তুমি যাহা বলিতে চাও তাহা সবই। কিন্তু কথা এই, তুমি জান কি না বিনোদিনী কোথায়।

 বিহারী। জানি।

 মহেন্দ্র। আমাকে বলিবে কিনা।

 বিহারী। না।

 মহেন্দ্র। বলিতেই হইবে। তুমি তাহাকে চুরি করিয়া আনিয়া লুকাইয়া রাখিয়াছ। সে আমার, তাহাকে ফিরাইয়া দাও।

 বিহারী ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া রহিল। তাহার পর দৃঢ় স্বরে বলিল, “সে তোমায় নহে। আমি তাহাকে চুরি করিয়া আনি নাই, সে নিজে আমার কাছে আসিয়া ধরা দিয়াছে।”

 মহেন্দ্র গর্জন করিয়া উঠিল, “মিথ্যা কথা!”

 এই বলিয়া পার্শ্ববর্তী ঘরের রুদ্ধ দ্বারে আঘাত দিতে দিতে উচ্চ স্বরে ডাকিল, “বিনোদ! বিনোদ!”