পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫৮
চোখের বালি

 ঘরের ভিতর হইতে কান্নার শব্দ শুনিতে পাইয়া বলিয়া উঠিল, “ভয় নাই বিনোদ। আমি মহেন্দ্র, আমি তোমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাইব― কেহ তোমাকে বন্ধ করিয়া রাখিতে পারিবে না।”

 বলিয়া মহেন্দ্র সবলে ধাক্কা দিতেই দ্বার খুলিয়া গেল। ভিতরে ছুটিয়া গিয়া দেখিল ঘরে অন্ধকার। অস্ফুট ছায়ার মতো দেখিতে পাইল, বিছানায় কে যেন ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া অব্যক্ত শব্দ করিয়া বালিশ চাপিয়া ধরিল। বিহারী তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া বসন্তকে বিছানা হইতে কোলে তুলিয়া সান্ত্বনার স্বরে বলিতে লাগিল, “ভয় নাই বসন্ত, ভয় নাই, কোনো ভয় নাই।”

 মহেন্দ্র তখন দ্রুতপদে বাহির হইয়া বাড়ির সমস্ত ঘর দেখিয়া আসিল। যখন ফিরিয়া আসিল তখনো বসন্ত ভয়ের আবেগে থাকিয়া থাকিয়া কাঁদিয়া উঠিতেছিল, বিহারী তাহার ঘরে আলো জ্বালিয়া তাহাকে বিছানায় শোয়াইয়া গায়ে হাত বুলাইয়া তাহাকে ঘুম পাড়াইবার চেষ্টা করিতেছিল।

 মহেন্দ্র আসিয়া কহিল, “বিনোদিনীকে কোথায় রাখিয়াছ।”

 বিহারী কহিল, “মহিনদা, গোল করিয়ো না, তুমি অকারণে এই বালককে যেরূপ ভয় পাওয়াইয়া দিয়াছ, ইহার অসুখ করিতে পারে। আমি বলিতেছি, বিনোদিনীর খবরে তোমার কোনো প্রয়োজন নাই।”

 মহেন্দ্র কহিল, “সাধু! মহাত্মা! ধর্মের আদর্শ খাড়া করিয়ো না। আমার স্ত্রীর এই ছবি কোলে করিয়া রাত্রে কোন্ দেবতার ধ্যানে কোন্ পুণ্য মন্ত্র জপ করিতেছিলে? ভণ্ড!”

 বলিয়া ছবিখানি মহেন্দ্র ভূমিতে ফেলিয়া জুতাসুদ্ধ পা দিয়া তাহার কাচ চূর্ণ চূর্ণ করিল এবং প্রতিমূর্তিটি লইয়া টুকরা টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া বিহারীর গায়ের উপর ফেলিয়া দিল।

 তাহার মত্ততা দেখিয়া বসন্ত আবার ভয়ে কাঁদিয়া উঠিল। বিহারীর কণ্ঠ রুদ্ধপ্রায় হইয়া আসিল; দ্বারের দিকে হস্তনির্দেশ করিয়া কহিল, “যাও!”

 মহেন্দ্র ঝড়ের বেগে বাহির হইয়া গেল।


৩৮

বিনোদিনী যখন যাত্রিশূন্য মেয়েদের গাড়িতে চড়িয়া বাতায়ন হইতে চষা মাঠ ও ছায়াবেষ্টিত এক-একখানি গ্রাম দেখিতে পাইল, তখন তাহার মনে স্নিগ্ধনিভৃত পল্লীর জীবনযাত্রা জাগিয়া উঠিল। সেই তরুচ্ছায়াবেষ্টনের মধ্যে তাহার স্বরচিত