পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬৮
চোখের বালি

নক্ষত্রগুলি, ঐ সপ্তর্ষি, ঐ কালপুরুষ, তাহাদের অনেক সন্ধ্যার অনেক নিভৃত প্রেমাভিনয়ের নীরব সাক্ষী ছিল— আজ তাহারা নিস্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল।

 মহেন্দ্র ভাবিতে লাগিল, ‘মাঝখানের কয়েকটিমাত্র দিনের বিপ্লবকাহিনী এই আকাশ-ভরা অন্ধকার দিয়া মুছিয়া ফেলিয়া যদি আগেকার ঠিক সেই দিনের মতো এই খোলা ছাদে মাদুর পাতিয়া আশার পাশে আমার সেই চিরন্তন স্থানটিতে অতি অনায়াসে গিয়া বসিতে পারি! কোনো প্রশ্ন নাই, জবাবদিহি নাই; সেই বিশ্বাস, সেই প্রেম, সেই সহজ আনন্দ!’ কিন্তু হায়, জগৎসংসারে সেইটুকুমাত্র জায়গায় ফিরিবার পথ আর নাই। এই ছাদে আশার পাশে মাদুরের একটুখানি ভাগ মহেন্দ্র একেবারে হারাইয়াছে। এতদিন বিনোদিনীর সঙ্গে মহেন্দ্রের অনেকটা স্বাধীন সম্বন্ধ ছিল; ভালোবাসিবার উন্মত্ত সুখ ছিল, কিন্তু তাহার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন ছিল না। এখন মহেন্দ্র বিনোদিনীকে সমাজ হইতে স্বহস্তে ছিন্ন করিয়া আনিয়াছে; এখন আর বিনোদিনীকে কোথাও রাখিবার, কোথাও ফিরাইয়া দিবার জায়গা নাই— মহেন্দ্রই তাহার একমাত্র নির্ভর। এখন ইচ্ছা থাক্ বা না থাক্, বিনোদিনীর সমস্ত ভার তাহাকে বহন করিতেই হইবে। এই কথা মনে করিয়া মহেন্দ্রের হৃদয় ভিতরে ভিতরে পীড়িত হইতে লাগিল। তাহাদের ছাদের উপরকার এই ঘরকন্না, এই শান্তি, এই বাধাবিহীন দাম্পত্যমিলনের নিভৃত রাত্রি, হঠাৎ মহেন্দ্রের কাছে বড়ো আরামের বলিয়া বোধ হইল। কিন্তু এই সহজলভ আরাম, যাহাতে একমাত্র তাহারই অধিকার, তাহাই আজ মহেন্দ্রের পক্ষে দুরাশার সামগ্রী। চিরজীবনের মতো যে বোঝা সে মাথায় তুলিয়াছে, তাহা নামাইয়া মহেন্দ্র এক মুহূর্তও হাঁপ ছাড়িতে পারিবে না।

 দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মহেন্দ্র একবার আশার দিকে চাহিয়া দেখিল। নিস্তব্ধ রোদনে বক্ষ পরিপূর্ণ করিয়া আশা তখনো নিশ্চল হইয়া বসিয়া আছে— রাত্রির অন্ধকার জননীর অঞ্চলের ন্যায় তাহার লজ্জা ও বেদনা আবৃত করিয়া রাখিয়াছে।

 মহেন্দ্র পায়চারি বন্ধ করিয়া কী বলিবার জন্য হঠাৎ আশার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। সমস্ত শরীরের রক্ত আশার কানের মধ্যে গিয়া শব্দ করিতে লাগিল। সে চক্ষু মুদ্রিত করিল। মহেন্দ্র কী বলিতে আসিয়াছিল ভাবিয়া পাইল না— তাহার কীই-বা বলিবার আছে। কিন্তু কিছু-একটা না বলিয়া আর ফিরিতে পারিল না; বলিল, “চাবির গোছাটা কোথায়।”

 চাবির গোছাটা ছিল বিছানার গদিটার নীচে। আশা উঠিয়া ঘরের মধ্যে