পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৬৯

গেল― মহেন্দ্র তাহার অনুসরণ করিল। গদির নীচে হইতে চাবি বাহির করিয়া আশা গদির উপরে রাখিয়া দিল। মহেন্দ্র চাবির গোছা লইয়া নিজের কাপড়ের আলমারিতে এক-একটি চাবি লাগাইয়া দেখিতে লাগিল। আশা আর থাকিতে পারিল না, মৃদুস্বরে কহিল, “ও আলমারির চাবি আমার কাছে ছিল না।”

 কাহার কাছে চাবি ছিল সে কথা আর আশার মুখ দিয়া বাহির হইল না, কিন্তু মহেন্দ্র তাহা বুঝিল। আশা তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল; ভয় হইল, পাছে মহেন্দ্রের কাছে আর তাহার কান্না চাপা না থাকে। অন্ধকার ছাদের প্রাচীরের এক কোণে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়া উচ্ছ্বসিত বোদনকে প্রাণপণে রুদ্ধ করিয়া সে কাঁদিতে লাগিল।

 কিন্তু অধিকক্ষণ কাঁদিবার সময় ছিল না। হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, মহেন্দ্রের আহারের সময় হইয়াছে। দ্রুতপদে আশা নীচে চলিয়া গেল।

 রাজলক্ষ্মী আশাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহিন কোথায় বউমা।”

 আশা কহিল, “তিনি উপরে।”

 রাজলক্ষ্মী। তুমি নামিয়া আসিলে যে!

 আশা নতমুখে কহিল, “তাঁহার খাবার―”

 রাজলক্ষ্মী। খাবারের আমি ব্যবস্থা করিতেছি— বউমা, তুমি একটু পরিষ্কার হইয়া লও। তোমার সেই নূতন ঢাকাই শাড়িখানা শীঘ্র পরিয়া আমার কাছে এসো, আমি তোমার চুল বাঁধিয়া দিই।

 শাশুড়ির আদর উপেক্ষা করিতে পারে না, কিন্তু এই সাজসজ্জার প্রস্তাবে আশা মরমে মরিয়া গেল। মৃত্যু ইচ্ছা করিয়া ভীষ্ম যেমন স্তব্ধ হইয়া শরবর্ষণ সহ্য করিয়াছিলেন, আশাও সেরূপ রাজলক্ষ্মীর কৃত সমস্ত প্রসাধন পরমধৈর্যে সর্বাঙ্গে গ্রহণ করিল।

 সাজ করিয়া আশা অতি ধীরে ধীরে নিঃশব্দ পদে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিল। উঁকি দিয়া দেখিল, মহেন্দ্র ছাদে নাই। আস্তে আস্তে দ্বারের কাছে আসিয়া দেখিল, মহেন্দ্র ঘরেও নাই, তাহার খাবার অভুক্ত পড়িয়া আছে।

 চাবির অভাবে কাপড়ের আলমারি জোর করিয়া খুলিয়া আবশ্যক কয়েকখান কাপড় ও ডাক্তারি বই লইয়া মহেন্দ্র চলিয়া গেছে।

 পরদিন একাদশী ছিল। অসুস্থ ক্লিষ্টদেহ রাজলক্ষ্মী বিছানায় পড়িয়া ছিলেন। বাহিরে ঘন মেঘে ঝড়ের উপক্রম করিয়া আছে। আশা ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। আস্তে আস্তে রাজলক্ষ্মীর পায়ের কাছে বসিয়া তাঁহার পায়ে হাত