পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭২
চোখের বালি

তাহার পরে কোন পথে চলা আবশ্যক স্থির করা যাইবে।’ কিছু না বুঝিয়া বিহারীকে বিরক্ত করিতে যাইতে তাহার আর সাহস হইল না।

 এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে যখন রাত্রি নয়টা-দশটা বাজিয়া গেল, তখন মহেন্দ্র ধীরে ধীরে আসিয়া উপস্থিত। কয়দিন অনিদ্রায় অনিয়মে অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় সে কাটাইয়াছে; আজ কৃতকার্য হইয়া বিনোদিনীকে বাসায় আনিয়া একেবারে অবসাদ ও শ্রান্তিতে তাহাকে যেন অভিভূত করিয়া দিয়াছে। আজ আর সংসারের সঙ্গে, নিজের অবস্থার সঙ্গে লড়াই করিবার বল যেন তাহার নাই। হার সমস্ত ভারাক্রান্ত ভাবী জীবনের ক্লান্তি যেন তাহাকে আজ আগে হইতে আক্রমণ করিল।

 রুদ্ধ হারের কাছে দাঁড়াইয়া ঘা দিতে মহেন্দ্রের অত্যন্ত লজ্জাবোধ হইতে লাগিল। যে উন্মত্ততায় সমস্ত পৃথিবীকে সে লক্ষ্য করে নাই, সে মত্ততা কোথায়। পথের অপরিচিত লোকের দৃষ্টির সম্মুখেও তাহার সর্বাঙ্গ সংকুচিত হইতেছে কেন।

 ভিতরে নূতন চাকরটা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে; দরজা খোলাইতে অনেক হাঙ্গাম করিতে হইল। অপরিচিত নূতন বাসার অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মহেন্দ্রের মন দমিয়া গেল। মাতার আদরের ধন মহেন্দ্র চিরদিন যে বিলাস-উপকরণে, যে-সকল টানাপাখা ও মূল্যবান চৌকি-সোফায় অভ্যস্ত, বাসার নূতন আয়োজনে তাহার অভাব সেই সন্ধ্যাবেলায় অত্যন্ত পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। এই-সমস্ত আয়োজন মহেন্দ্রকে সম্পূর্ণ করিতে হইবে, বাসার সমস্ত ব্যবস্থার ভার তাহারই উপরে। মহেন্দ্র কখনো নিজের বা পরের আরামের জন্য চিন্তা করে নাই— আজ হইতে একটি নূতনগঠিত অসম্পূর্ণ সংসারের সমস্ত খুঁটিনাটি তাহাকেই বহন করিতে হইবে। সিঁড়িতে একটা কেরোসিনের ডিবা অপর্যাপ্ত ধূমোদ্গার করিয়া মিট্‌মিট্ করিতেছিল; তাহার পরিবর্তে একটা ভালো ল্যাম্প্‌ কিনিতে হইবে। বারান্দা বাহিয়া সিঁড়িতে উঠিবার রাস্তাটা কলের জলের প্রবাহে স্যাঁতস্যাঁত করিতেছে; মিস্ত্রি ডাকাইয়া বিলাতি মাটির দ্বারা সে জায়গা মেরামত করা আবশ্যক। রাস্তার দিকে দুটো ঘর যে জুতার দোকানদারদের হাতে ছিল, তাহারা সে দুটো ঘর এখনো ছাড়ে নাই, তাহা লইয়া বাড়িওয়ালার সহিত লড়াই করিতে হইবে। এইসমস্ত কাজ তাহার নিজে না করিলে নয়, ইহাই চকিতের মধ্যে মনে উদয় হইয়া তাহার শ্রান্তির বোঝায় আরো বোঝা চাপিল।

 মহেন্দ্র সিঁড়ির কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া নিজেকে সামলাইয়া লইল— বিনোদিনীর প্রতি তাহার যে প্রেম ছিল তাহাকে উত্তেজিত করিল। নিজেকে