পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭৪
চোখের বালি

বিনোদ, বইটইগুলো তুমি রাস্তায় টান মারিয়া ফেলিয়া দিয়ো, আমি আপত্তিমাত্র করিব না, কেবল সেইসঙ্গে আমাকেও ফেলিয়ো না।

 বলিয়া এই উপলক্ষে মহেন্দ্র একটুখানি সরিয়া আসিয়া কাপড়ে-বাঁধা বইয়ের পুঁটুলি বিনোদিনীর পায়ের কাছে আনিয়া ফেলিল।

 বিনোদিনী গম্ভীর মুখে সেলাই করিতে করিতে মাথা না তুলিয়া বলিল, “ঠাকুরপো, এখানে তোমার থাকা হইবে না।”

 মহেন্দ্র তাহার সদ্যোজাগ্রত আগ্রহের মুখে প্রতিঘাত পাইয়া ব্যাকুল হইয়া উঠিল; গদ্‌গদকণ্ঠে কহিল, “কেন বিনোদ, কেন তুমি আমাকে দূরে রাখিতে চাও। তোমার জন্য সমস্ত ত্যাগ করিয়া কি এই পাইলাম।”

 বিনোদিনী। আমার জন্য তোমাকে সমস্ত ত্যাগ করিতে দিব না।

 মহেন্দ্র বলিয়া উঠিল, “এখন সে আর তোমার হাতে নাই— সমস্ত সংসার আমার চারি দিক হইতে স্খলিত হইয়া পড়িয়াছে, কেবল তুমি একলা আছ, বিনোদ! বিনোদ― বিনোদ―”

 বলিতে বলিতে মহেন্দ্র শুইয়া পড়িয়া বিহ্বলভাবে বিনোদিনীর পা জোর করিয়া চাপিয়া ধরিল এবং তাহার পদপল্পব বারংবার চুম্বন করিতে লাগিল।

 বিনোদিনী পা ছাড়াইয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। কহিল, “মহেন্দ্র, তুমি কী প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলে মনে নাই?”

 সমস্ত বলপ্রয়োগ করিয়া মহেন্দ্র আত্মসংবরণ করিয়া লইল; কহিল, “মনে আছে। শপথ করিয়াছিলাম, তোমার যাহা ইচ্ছা তাহাই হইবে, আমি কখনো তাহার কোনো অন্যথা করিব না। সেই শপথই রক্ষা করিব। কী করিতে হইবে বলো।”

 বিনোদিনী। তুমি তোমার বাড়িতে গিয়া থাকিবে।

 মহেন্দ্র। আমিই কি তোমার একমাত্র অনিচ্ছার সামগ্রী বিনোদ। তাই যদি হইবে, তবে তুমি আমাকে টানিয়া আনিলে কেন? যে তোমার ভোগের সামগ্রী নয়, তাহাকে শিকার করিবার কী প্রয়োজন ছিল। সত্য করিয়া বলো, আমি কি ইচ্ছা করিয়া তোমার কাছে ধরা দিয়াছি, না, তুমি ইচ্ছা করিয়া আমাকে ধরিয়াছ। আমাকে লইয়া তুমি এইরূপ খেলা করিবে, ইহাও কি আমি সহ্য করিব। তবু আমি আমার শপথ পালন করিব― যে বাড়িতে আমি নিজের স্থান পদাঘাতে চূর্ণ করিয়া ফেলিয়াছি সেই বাড়িতে গিয়াই আমি থাকিব।

 বিনোদিনী ভূমিতে বসিয়া পুনরায় নিরুত্তরে সেলাই করিতে লাগিল।