পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮০
চোখের বালি

 রাজলক্ষ্মী বিশ্বাস করিলেন না। এ কি কখনো সম্ভব হয়।

 জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাল মহিন কখন গেল।”

 আশা সংকুচিত হইয়া কহিল, “জানি না।”

 রাজলক্ষ্মী অত্যন্ত রাগিয়া উঠিয়া কহিলেন, “তুমি কিছুই জান না। কচি খুকি। তোমার সমস্ত চালাকি।”

 আশারই আচরণে ও স্বভাবদোষেই যে মহেন্দ্র গৃহত্যাগ হইয়াছে, এ মতও রাজলক্ষ্মী তীব্র স্বরে ঘোষণা করিয়া দিলেন। আশা নতমস্তকে সেই ভর্ৎসনা বহন করিয়া নিজের ঘরে গিয়া কাঁদিতে লাগিল। মনে ভাবিল, ‘কেন যে আমাকে আমার স্বামী একদিন ভালোবাসিয়াছিলেন তাহা আমি জানি না, এবং কেমন করিয়া যে তাঁহার ভালোবাসা ফিরিয়া পাইব তাহাও আমি বলিতে পারি না।’ যে লোক ভালোবাসে তাহাকে কেমন করিয়া খুশি করিতে হয় তাহা হৃদয় আপনি বলিয়া দেয়; কিন্তু যে ভালোবাসে না তাহার মন কী করিয়া পাইতে হয় আশা তাহার কী জানে। যে লোক অন্যকে ভালোবাসে তাহার নিকট হইতে সোহাগ লইতে যাওয়ার মতো এমন নিরতিশয় লজ্জাকর চেষ্টা সে কেমন করিয়া করিবে।

 সন্ধ্যাকালে বাড়ির দৈবজ্ঞ-ঠাকুর এবং তাঁহার ভগিনী আচার্য-ঠাকরুন আসিয়াছেন। ছেলের গ্রহশান্তির জন্য রাজলক্ষ্মী ইঁহাদিগকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছিলেন। রাজলক্ষ্মী একবার বউমার কোষ্ঠী এবং হাত দেখিবার জন্য দৈবজ্ঞকে অনুবোধ করিলেন এবং সেই উপলক্ষে আশাকে উপস্থিত করিলেন। পরের কাছে নিজের দুর্ভাগ্য-আলোচনার সংকোচে একান্ত কুণ্ঠিত হইয়া আশা কোনোমতে তাহার হাত বাহির করিয়া বসিয়াছে, এমন সময় রাজলক্ষ্মী তাঁহার ঘরের পার্শ্বস্থ দীপহীন বারান্দা দিয়া মৃদু জুতার শ পাইলেন— কে যেন গোপনে চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছে। রাজলক্ষ্মী ডাকিলেন, “কে ও।”

 প্রথমে সাড়া পাইলেন না। তাহার পর আবার ডাকিলেন, “কে যায় গো।”

 তখন নিরুত্তরে মহেন্দ্র ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল।

 আশা খুশি হইবে কি, মহেন্দ্রের লজ্জা দেখিয়া লজ্জায় তাহার হৃদয় ভরিয়া গেল। মহেন্দ্রকে এখন নিজের বাড়িতেও চোরের মতো প্রবেশ করিতে হয়। দৈবজ্ঞ এবং আচার্য-ঠাকরুন বসিয়া আছেন বলিয়া তাহার আরো লজ্জা হইল। সমস্ত পৃথিবীর কাছে নিজের স্বামীর জন্য যে লজ্জা, ইহাই আশার দুঃখের চেয়েও যেন বেশি হইয়া উঠিয়াছে। রাজলক্ষ্মী যখন মৃদু স্বরে বউকে বলিলেন, “বউমা,