পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৯২
চোখের বালি

আশা যে কোনো কালে কোনো অবস্থাতেই মহেন্দ্রকে এমন ধিক্কার করিতে পারে তাহা মহেন্দ্র কল্পনাও করিতে পারে নাই। মহেন্দ্র দেখিল, যেখানে তাহার সিংহাসন ছিল সেখানে সে ধূলায় লুটাইতেছে। এতদিন পরে তাহার আশঙ্কা হইল, পাছে আশার বেদনা ঘৃণায় পরিণত হয়।

 ও দিকে বিহারীর কথা মনে আসিতেই বিনোদিনী সম্বন্ধে চিন্তা তাহাকে অধীর করিয়া তুলিল। বিহারী পশ্চিম হইতে ফিরিয়াছে কি না, কে জানে। ইতিমধ্যে বিনোদিনী তাহার ঠিকানা জানিতেও পারে, বিনোদিনীর সঙ্গে বিহারীর দেখা হওয়াও অসম্ভব নহে। মহেন্দ্রের আর প্রতিজ্ঞা রক্ষা হয় না।

 রাত্রে রাজলক্ষ্মীর বক্ষের কষ্ট বাড়িল, তিনি আর থাকিতে না পারিয়া নিজেই মহেন্দ্রকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। কষ্টে বাক্য উচ্চারণ করিয়া কহিলেন, “মহিন, বিহারীকে আমার বড়ো দেখিতে ইচ্ছা হয়, অনেক দিন সে আসে নাই।”

 আশা শাশুড়িকে বাতাস করিতেছিল। সে মুখ নিচু করিয়া রহিল। মহেন্দ্র কহিল, “সে এখানে নাই, পশ্চিমে কোথায় চলিয়া গেছে।”

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার মন বলিতেছে, সে এখানেই আছে, কেবল তোর উপর অভিমান করিয়া আসিতেছে না। আমার মাথা খা, কাল একবার তুই তাহার বাড়িতে যাস।”

 মহেন্দ্র কহিল, “আচ্ছা যাব।”

 আজ সকলেই বিহারীকে ডাকিতেছে। মহেন্দ্র নিজেকে বিশেষ পরিত্যক্ত বলিয়া বোধ করিল।


৪৫

পরদিন প্রত্যুষেই মহেন্দ্র বিহারীর বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল। দেখিল, দ্বারের কাছে অনেকগুলা গোরুর গাড়িতে ভৃত্যগণ আসবাব বোঝাই করিতেছে। ভজুকে মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “ব্যাপারখানা কি।” ভজু কহিল, “বাবু বালিতে গঙ্গার ধারে একটি বাগান লইয়ছেন, সেইখানে জিনিসপত্র চলিয়াছে।” মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “বাবু বাড়িতে আছেন, না কী।” ভজু কহিল, “তিনি দুইদিন মাত্র কলিকাতায় থাকিয়া কাল বাগানে চলিয়া গেছেন।”

 শুনিয়া মহেন্দ্রের মন আশঙ্কায় পূর্ণ হইয়া গেল। সে অনুপস্থিত ছিল, ইতিমধ্যে বিনোদিনী ও বিহারীতে যে দেখা হইয়াছে, ইহাতে তাহার মনে কোনো সংশয় রহিল না। সে কল্পনাচক্ষে দেখিল, বিনোদিনীর বাধার সম্মুখেও এতক্ষণে গোরুর