পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৯৩

গাড়ি বোঝাই হইতেছে। তাহার নিশ্চয় বোধ হইল, ‘এইজন্যই নির্বোধ আমাকে বিনোদিনী বাসা হইতে দূরে রাখিয়াছিল।’

 মুহূর্তকাল বিলম্ব না করিয়া মহেন্দ্র তাহার গাড়িতে চড়িয়া কোচম্যানকে হাঁকাইতে কহিল। ঘোড়া যথেষ্ট দ্রুত চলিতেছে না বলিয়া মহেন্দ্র মাঝে মাঝে কোচম্যানকে গালি দিল। গলির মধ্যে সেই বাসার দ্বারের সম্মুখে পৌঁছিয়া দেখিল, সেখানে যাত্রার কোনো আয়োজন নাই। ভয় হইল, পাছে সে কার্য পূর্বেই সমাধা হইয়া থাকে। বেগে দ্বারে আঘাত করিল। ভিতর হইতে বৃদ্ধ চাকর দরজা খুলিয়া দিবা মাত্র মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “সব খবর ভালো তো?”

 সে কহিল, “আজ্ঞা হাঁ, ভালো বৈকি।”

 মহেন্দ্র উপরে গিয়া দেখিল, বিনোদিনী স্নানে গিয়াছে। তাহার নির্জন শয়নঘরে প্রবেশ করিয়া মহেন্দ্র বিনোদিনীর গতরাত্রে-ব্যবহৃত শয্যার উপর লুটাইয়া পড়িল—সেই কোমল আস্তরণকে দুই প্রসারিত হস্তে বক্ষের কাছে আকর্ষণ করিল এবং তাহাকে ঘ্রাণ করিয়া তাহার উপরে মুখ রাখিয়া বলিতে লাগিল, ‘নিষ্ঠুর! নিষ্ঠুর!’

 এইরূপে হৃদয়োচ্ছ্বাস উন্মুক্ত করিয়া শয্যা হইতে উঠিয়া মহেন্দ্র অধির ভাবে বিনোদিনীর প্রতীক্ষা করিতে লাগিল; ঘরের মধ্যে পায়চারি করিতে করিতে দেখিল, একখানা বাংলা খবরের কাগজ নীচের বিছানায় খোলা পড়িয়া আছে। সময় কাটাইবার জন্য কতকটা অন্যমনস্ক ভাবে সেখানা তুলিয়া লইয়া, যেখানে চোখ পড়িল, মহেন্দ্র সেখানেই বিহারীর নাম দেখিতে পাইল। এক মুহূর্তে তাহার সমস্ত মন খবরের কাগজের সেই জায়গাটাতে ঝুঁকিয়া পড়িল। একজন পত্রপ্রেরক লিখিতেছে, অল্প বেতনের দরিদ্র কেরানিগণ রুগ্‌ণ হইয়া পড়িলে তাহাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও সেবার জন্য বিহারী বালিতে গঙ্গার ধারে একটি বাগান লইয়াছেন— সেখানে এককালে পাঁচজনকে আশ্রয় দিবার বন্দোবস্ত হইয়াছে, ইত্যাদি।

 বিনোদিনী এই খবরটা পড়িয়াছে; পড়িয়া তাহার কিরূপ ভাব হইল। নিশ্চয় তাহার মনটা সেই দিকে পালাই-পালাই করিতেছে। শুধু সেজন্য নহে, মহেন্দ্রের মন এই কারণে আরো ছট্‌ফট্‌ করিতে লাগিল যে, বিহারীর এই সংকল্পে তাহার প্রতি বিনোদিনীর ভক্তি আরো বাড়িয়া উঠিবে। বিহারীকে মহেন্দ্র মনে মনে 'হাম্বাগ’ বলিল, বিহারীর এই কাজটাকে ‘হুজুগ’ বলিয়া অভিহিত করিল; কহিল, ‘লোকের হিতকারী হইয়া উঠিবার হুজুগ বিহারীর ছেলেবেলা হইতেই আছে।’