পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৯৫

হইতে সে নিজেকে কেমন করিয়া রক্ষা করিবে। একে বিনোদিনীর ব্যথিত হৃদয়, তাহাতে এই ক্ষুদ্র অবরুদ্ধ বাসা, তাহাতে মহেন্দ্রের বাসনা-তরঙ্গের অহরহ অভিঘাত― ইহা কল্পনা করিয়াও বিনোদিনীর সমস্ত চিত্ত আতঙ্কে পীড়িত হইয়া উঠে। জীবনে ইহার সমাপ্তি কোথায়। কবে সে এই সমস্ত হইতে বাহির হইতে পারিবে।

 বিনোদিনীর সেই কৃশ পাণ্ডুর মুখ দেখিয়া মহেন্দ্রের মনে ঈর্ষানল জ্বলিয়া উঠিল। তাহার কি এমন কোনো শক্তি নাই, যাহা-দ্বারা সে বিহারীর চিন্তা হইতে এই তপস্বিনীকে বলপূর্বক উৎপাটিত করিয়া লইতে পারে। ঈগল যেমন মেষশাবককে নিমেষে ছোঁ মারিয়া তাহার সুদুর্গম অভ্রভেদী পর্বতনীড়ে উত্তীর্ণ করে, তেমনি এমন কি কোনো মেঘপরিবৃত নিখিলবিস্মৃত স্থান নাই যেখানে একাকী মহেন্দ্র তাহার এই কোমল সুন্দর শিকারটিকে আপনার বুকের কাছে লুকাইয়া রাখিতে পারে। ঈর্ষার উত্তাপে হার ইচ্ছার আগ্রহ চতুর্গুণ বাড়িয়া উঠিল। আর কি সে এক মুহূর্তও বিনোদিনীকে চোখের আড়াল করিতে পারিবে। বিহারীর বিভীষিকাকে অহরহ ঠেকাইয়া রাখিতে হইবে, তাহাকে সূচ্যগ্রমাত্র অবকাশ দিতে আর তো মহেন্দ্রের সাহস হইবে না।

 বিরহতাপে রমণীর সৌন্দর্যকে সুকুমার করিয়া তোলে, মহেন্দ্র এ কথা সংস্কৃত কাব্যে পড়িয়াছিল; আজ বিনোদিনীকে দেখিয়া সে তাহা যতই অনুভব করিতে লাগিল ততই সুখমিশ্রিত দুঃখের সুতীব্র আলোড়নে তাহার হৃদয় একান্ত মথিত হইয়া উঠিল।

 বিনোদিনী ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কি চা খাইয়া আসিয়াছ।”

 মহেন্দ্র কহিল, “না-হয় খাইয়া আসিয়াছি, তাই বলিয়া স্বহস্তে আর-এক পেয়ালা দিতে কৃপণতা করিয়ে না― ‘প্যালা মুঝ ভর্ দে রে’।”

 বিনোদিনী বোধ হয় ইচ্ছা করিয়া নিতান্ত নিষ্ঠুরভাবে মহেন্দ্রের এই উচ্ছ্বাসে হঠাৎ আঘাত দিল; কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো এখন কোথায় আছেন খবর জান?”

 মহেন্দ্র নিমেষের মধ্যে বিবর্ণ হইয়া কহিল, “সে তো এখন কলিকাতার নাই।”

 বিনোদিনী। তাহার ঠিকানা কী।

 মহেন্দ্র। সে তো কাহাকেও বলিতে চাহে না।

 বিনোদিনী। সন্ধান করিয়া কি খবর লওয়া যায় না।