পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬
চোখের বালি

 মহেন্দ্র কহিল, “কাজ কী এত কষ্ট করিয়া। তোমার বোঝা নাহয় আমিই স্কন্ধে তুলিয়া লই। কী বল।”

 বিহারী গম্ভীরভাবে মহেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিল। কহিল, “মহিনদা, সত্য বলিতেছ? এখনো ঠিক করিয়া বলো। তুমি বিবাহ করিলে কাকী ঢের বেশি খুশি হইবেন— তাহা হইলে তিনি মেয়েটিকে সর্বদাই কাছে রাখিতে পারিবেন।”

 মহেন্দ্র কহিল, “তুমি পাগল হইয়াছ? সে হইলে অনেক কাল আগে হইয়াযাইত।”

 বিহারী অধিক আপত্তি না করিয়া চলিয়া গেল, মহেন্দ্রও সোজা পথ ছাড়িয়া দীর্ঘ পথ ধরিয়া বহু বিলম্বে ধীরে ধীরে বাড়ি গিয়া পৌছিল।

 মা তখন লুচি-ভাজা ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন, কাকী তখনে তাঁহার বোনঝির নিকট হইতে ফেরেন নাই।

 মহেন্দ্র এক নির্জন ছাদের উপর গিয়া মাদুর পাতিয়া শুইল। কলিকাতার হর্ম্যশিখরপুঞ্জের উপর শুক্লসপ্তমীর অর্ধচন্দ্র নিঃশব্দে আপন অপরূপ মায়ামন্ত্র বিকীর্ণ করিতেছিল। মা যখন খাবার খবর দিলেন, মহেন্দ্র অলস স্বরে কহিল, “বেশ আছি, এখন আর উঠিতে পারি না।”

 মা কহিলেন, “এইখানেই আনিয়া দিই-না?”

 মহেন্দ্র কহিল, “আজ আর খাইব না, আমি খাইয়া আসিয়াছি।”

 মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় খাইতে গিয়াছিলি।”

 মহেন্দ্র কহিল, “সে অনেক কথা, পরে বলিব।”

 মহেন্দ্রের এই অভূতপূর্ব ব্যবহারে অভিমানিনী মাতা কোনো উত্তর না করিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন।

 তখন মুহূর্তের মধ্যে আত্মসম্বরণ করিয়া অনুতপ্ত মহেন্দ্র কহিল, “মা, আমার খাবার এইখানেই আনো।”

 মা কহিলেন, “ক্ষুধা না থাকে তো দরকার কী।”

 এই লইয়া ছেলেতে মায়েতে কিয়ৎক্ষণ মান-অভিমানের পর মহেন্দ্রকে পুনশ্চ আহারে বসিতে হইল।


রাত্রে মহেন্দ্রের ভালো নিদ্রা হইল না। প্রত্যুষেই সে বিহারীর বাসায় আসিয়া উপস্থিত। কহিল, “ভাই, ভাবিয়া দেখিলাম, কাকীমার মনোগত ইচ্ছা, আমিই তাহার বোনঝিকে বিবাহ করি।”