পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৯৬
চোখের বালি

 মহেন্দ্র। আমার তো তেমন জরুরি দরকার কিছু দেখি না।

 বিনোদিনী। দরকারই কি সব। আশৈশব বন্ধুত্ব কি কিছুই নয়।

 মহেন্দ্র। বিহারী আমার আশৈশব বন্ধু বটে, কিন্তু তোমার সঙ্গে তাহার বন্ধুত্ব দু-দিনের― তবু তাগিদটা তোমারই যেন অত্যন্ত বেশি বোধ হইতেছে।

 বিনোদিনী। তাহাই দেখিয়া তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত। বন্ধুত্ব কেমন করিয়া করিতে হয় তাহা তোমার অমন বন্ধুর কাছ হইতেও শিখিতে পারিলে না?

 মহেন্দ্র। সেজন্য তত দুঃখিত নহি, কিন্তু ফাঁকি দিয়া স্ত্রীলোকের মন হরণ কেমন করিয়া করিতে হয় সে বিদ্যা তাহার কাছে শিখিলে আজ কাজে লাগিতে পারিত।

 বিনোদিনী। সে বিদ্যা কেবল ইচ্ছা থাকিলেই শেখা যায় না, ক্ষমতা থাকা চাই।

 মহেন্দ্র। গুরুদেবের ঠিকানা যদি তোমার জানা থাকে তো বলিয়া দাও, এ বয়সে তাঁহার কাছে একবার মন্ত্র লইয়া আসি, তাহার পরে ক্ষমতার পরীক্ষা।

 বিনোদিনী। বন্ধুর ঠিকানা যদি বাহির করিতে না পার, তবে প্রেমের কথা আমার কাছে উচ্চারণ করিয়ো না। বিহারী-ঠাকুরপোর সঙ্গে তুমি যেরূপ ব্যবহার করিয়াছ, তোমাকে কে বিশ্বাস করিতে পারে।

 মহেন্দ্র। আমাকে যদি সম্পূর্ণ বিশ্বাস না করিতে, তবে আমাকে এত অপমান করিতে পারিতে না। আমার ভালোবাসা সম্বন্ধে যদি এত নিঃসংশয় না হইতে, তবে হয়তো আমার এত অসহ্য দুঃখ ঘটিত না। বিহারী পোষ না মানিবার বিদ্যা জানে, সে বিদ্যাটা যদি সে এই হতভাগ্যকে শিখাইত তবে বন্ধুত্বের কাজ করিত।

 “বিহারী যে মানুষ, তাই সে পোষ মানিতে পারে না” এই বলিয়া বিনোদিনী খোলা চুল পিঠে মেলিয়া যেমন জানলার কাছে দাঁড়াইয়া ছিল তেমনি দাঁড়াইয়া রহিল। মহেন্দ্র হঠাৎ দাঁড়াইয়া উঠিয়া মুষ্টি বন্ধ করিয়া রোষগর্জিত স্বরে কহিল, “কেন তুমি আমাকে বারবার অপমান করিতে সাহস কর। এত অপমানের যে কোনো প্রতিফল পাও না, সে কি তোমার ক্ষমতায়, না আমার গুণে। আমাকে যদি পশু বলিয়াই স্থির করিয়া থাক, তবে হিংস্র পশু বলিয়াই জানিয়ো। আমি একেবারে আঘাত করিতে জানি না, এত বড় কাপুরুষ নই।”

 বলিয়া বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিয়া ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া রহিল― তাহার পর বলিয়া উঠিল, “বিনোদ, এখান হইতে কোথাও চলো। আমরা রাহির হইয়া