পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৯৮
চোখের বালি

কোনো আশঙ্কাকে কোনো কর্তব্যকে মনে স্থান দিতে চায় না, তাই সে মাতার কষ্টকে পীড়াকে এতই লঘু করিয়া দেখিয়াছে― পাছে জননীর রোগশয্যায় তাহাকে আবদ্ধ হইয়া পড়িতে হয়, তাই সে এমন নির্লজ্জের মতো একটু অবকাশ পাইতেই বিনোদিনীর কাছে পলায়ন করিয়াছে। রোগ আরোগ্যের প্রতি রাজলক্ষ্মীর আর লেশমাত্র উৎসাহ রহিল না― মহেন্দ্রের অনুদ্‌বেগ যে অমূলক, দারুণ অভিমানে ইহাই তিনি প্রমাণ করিতে চাহিলেন।

 বেলা দুটার সময় আশা কহিল, “মা, তোমার ওষুধ খাইবার সময় হইয়াছে।” রাজলক্ষ্মী উত্তর না দিয়া চুপ করিয়া রহিলেন। আশা ওষুধ আনিবার জন্য উঠিলে তিনি বলিলেন, “ওষুধ দিতে হবে না বউমা, তুমি যাও।”

 আশা মাতার অভিমান বুঝিতে পারিল―সেই অভিমান সংক্রামক হইয়া তাহার হৃদয়ের আন্দোলনে দ্বিগুণ দোলা দিতেই আশা আর থাকিতে পারিল না, কান্না চাপিতে চাপিতে গুমরিয়া কাঁদিয়া উঠিল। রাজলক্ষ্মী ধীরে ধীরে আশার দিকে পাশ ফিরিয়া তাহার হাতের উপরে সকরুণ স্নেহে আস্তে আস্তে হাত বুলাইতে লাগিলেন; কহিলেন, “বউমা, তোমার বয়স অল্প, এখনো তোমার সুখের মুখ দেখিবার সময় আছে। আমার জন্য তুমি আর বৃথা চেষ্টা করিয়ো না বাছা―আমি তো অনেক দিন বাঁচিয়াছি— আর কী হইবে।”

 শুনিয়া আশার রোদন আরো উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, সে মুখের উপর আঁচল চাপিয়া ধরিল।

 এইরূপে রোগীর গৃহে নিরানন্দ দিন মন্দ গতিতে কাটিয়া গেল। অভিমানের মধ্যেও এই দুই নারীর ভিতরে ভিতরে আশা ছিল, এখনই মহেন্দ্র আসিবে। শব্দমাত্রেই উভয়ের দেহে যে-একটি চমক-সঞ্চার হইতেছিল, তাহা উভয়েই বুঝিতে পারিতেছিলেন। ক্রমে দিবাবসানের আলোক অস্পষ্ট হইয়া আসিল; কলিকাতার অন্তঃপুরের মধ্যে সেই গোধুলির যে আভা তাহাতে আলোকের প্রফুল্লতাও নাই, অন্ধকারের আবরণও নাই― তাহা বিষাদকে গুরুভার এবং নৈরাশ্যকে অশ্রুহীন করিয়া তোলে, তাহা কর্ম ও আশ্বাসের বল হরণ করে, অথচ বিশ্রাম ও বৈরাগ্যের শান্তি আনয়ন করে না। রুগ্‌ণগৃহের সেই শুষ্ক শ্রীহীন সন্ধ্যায় আশা নিঃশব্দপদে উঠিয়া একটি প্রদীপ জ্বালিয়া ঘরে আনিয়া দিল। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “বউমা, আলো ভালো লাগিতেছে না, প্রদীপ বাহিরে রাখিয়া দাও।”

 আশা প্রদীপ বাহিরে রাখিয়া আসিয়া বসিল। অন্ধকার যখন ঘনতর হইয়া এই ক্ষুদ্র কক্ষের মধ্যে বাহিরের অনন্ত রাত্রিকে আনিয়া দিল তখন আশা