বিহারী কহিল, “মা, তোমার অসুখ, এ খবর আমাকে কেন জানাইলে না। তাহা হইলে কি আমি এক মুহূর্ত বিলম্ব করিতাম।”
রাজলক্ষ্মী মৃদুস্বরে কহিলেন, “সে কি আর আমি জানি না বাছা। তোকে পেটে ধরি নাই বটে, কিন্তু জগতে তোর চেয়ে আমার আপনার আর কি কেহ আছে।”
বলিতে বলিতে তাঁহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল।
বিহারী তাড়াতাড়ি উঠিয়া ঘরের কুলুঙ্গিতে ওষুধপত্রের শিশি-কৌটাগুলি পরীক্ষা করিবার ছলে আত্মসংবরণের চেষ্টা করিল। ফিরিয়া আসিয়া সে যখন রাজলক্ষ্মীর নাড়ি দেখিতে উদ্যত হইল রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার নাড়ির খবর থাক্― জিজ্ঞাসা করি, তুই এমন রোগা হইয়া গেছিস কেন বেহারি।”
বলিয়া রাজলক্ষ্মী তাঁহার কৃশ হস্ত তুলিয়া বিহারীর কণ্ঠায় হাত বুলাইয়া দেখিলেন।
বিহারী কহিল, “তোমার হাতের মাছের ঝোল না খাইলে আমার এ হাড় কিছুতেই ঢাকিবে না। তুমি শীঘ্র শীঘ্র সারিয়া ওঠো মা, আমি ততক্ষণ রান্নার আয়োজন করিয়া রাখি।”
রাজলক্ষ্মী ম্লান হাসি হাসিয়া কহিলেন, “সকাল সকাল আয়োজন কর্ বাছা― কিন্তু রান্নার নয়।”
বলিয়া বিহারীর হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, “বেহারি, তুই বউ ঘরে নিয়ে আয়, তোকে দেখিবার লোক কেহ নাই। ও মেজবউ, তোমরা এবার বেহারির একটি বিয়ে দিয়ে দাও― দেখোনা, বাছার চেহারা কেমন হইয়া গেছে।”
অন্নপূর্ণা কহিলেন, “তুমি সারিয়া ওঠো দিদি। এ তো তোমারই কাজ, তুমি সম্পন্ন করিবে, আমরা সকলে যোগ দিয়া আমোদ করিব।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার আর সময় হইবে না মেজবউ, বেহারির ভার তোমাদেরই উপর রহিল— উহাকে সুখী করিয়ো, আমি উহার ঋণ শুধিয়া যাইতে পারিলাম না— কিন্তু ভগবান উহার ভালো করিবেন।”
বলিয়া বিহারীর মাথায় তাঁহার দক্ষিণ হস্ত বুলাইয়া দিলেন।
আশা আর ঘরে থাকিতে পারিল না— কাঁদিবার জন্য বাহিরে চলিয়া গেল। অন্নপূর্ণা অশ্রুজলের ভিতর দিয়া বিহারীর মুখের প্রতি স্নেহদৃষ্টিপাত করিলেন।
রাজলক্ষ্মীর হঠাৎ কী মনে পড়িল; তিনি ডাকিলেন, “বউমা, ও বউমা।”
আশা ঘরে প্রবেশ করিতেই কহিলেন, “বেহারির খাবারের সব ব্যবস্থা করিয়াছ তো?”