পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
২১১

আমি তাহাই করিব। তাহার ঠিকানা কেহ কি জানে।”

 অন্নপূর্ণা। ঠিক জানে না, খুঁজিয়া লইতে হইবে। বিহারি, আর-একটা কথা তোর কাছে বলি। আশার মুখের দিকে চাস্। বিনোদিনীর হাত হইতে মহেন্দ্রকে যদি উদ্ধার করিতে না পারিস, তবে সে আর বাঁচিবে না। তাহার মুখ দেখিলেই বুঝিতে পারিবি তার বুকে মৃত্যুবাণ বাজিয়াছে।

 বিহারী মনে মনে তীব্র হাসি হাসিয়া ভাবিল, ‘পরকে উদ্ধার আমি করিতে যাইব— ভগবান, আমার উদ্ধার কে করিবে।’ কহিল, “বিনোদিনীর আকর্ষণ হইতে চিরকালের জন্য মহেন্দ্রকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারিব, এমন মন্ত্র আমি কি জানি কাকীমা। মার ব্যামোতে সে দু-দিন শান্ত হইয়া থাকিতে পারে, কিন্তু আবার সে যে ফিরিবে না তাহা কেমন করিয়া বলিব।”

 এমন সময় মলিনবসনা আশা মাথায় আধখানা ঘোমটা দিয়া ধীরে ধীরে তাহার মাসিমার পায়ের কাছে আসিয়া বসিল। সে জানিত রাজলক্ষ্মীর পীড়া সম্বন্ধে বিহারীর সঙ্গে অন্নপূর্ণার আলোচনা চলিতেছে, তাই ঔৎসুক্যের সহিত শুনিতে আসিল। পতিব্রতা আশার মুখে নিস্তব্ধ দুঃখের নীরব মহিমা দেখিয়া বিহারীর মনে এক অপূর্ব ভক্তির সঞ্চার হইল। শোকের তপ্ত তীর্থজলে অভিষিক্ত হইয় এই তরুণী রমণী প্রাচীন যুগের দেবীদের ন্যায় একটি অচঞ্চল মর্যাদা লাভ করিয়াছে— সে এখন আর সামান্যা নারী নহে, সে যেন দারুণ দুঃখে পুরাণবণিতা সাধ্বীদের সমান বয়স প্রাপ্ত হইয়াছে।

 বিহারী আশার সহিত রাজলক্ষ্মীর পথ্য ও ঔষধ সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া যখন আশাকে বিদায় করিল তখন একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া অন্নপূর্ণাকে কহিল, “মহেন্দ্রকে আমি উদ্ধার করিব।”

 বিহারী মহেন্দ্রের ব্যাঙ্কে গিয়া খবর পাইল যে, তাহাদের এলাহাবাদ-শাখার সহিত মহেন্দ্র অল্পদিন হইতে লেনাদেনা আরম্ভ করিয়াছে।


৫০

স্টেশনে আসিয়া বিনোদিনী একেবারে ইণ্টারমিডিয়েট ক্লাসে মেয়েদের গাড়িতে চড়িয়া বসিল। মহেন্দ্র কহিল, ও কী কর, আমি তোমার জন্যে সেকেণ্ড্ ক্লাসের টিকিট কিনিতেছি।”

 বিনোদিনী কহিল, “দরকার কী, এখানে আমি বেশ থাকিব।”