পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২১৪
চোখের বালি

 বিনোদিনী নিজের ইচ্ছামত মহেন্দ্রকে চালাইতেছে, অথচ তাহার ক্ষুধিত অতৃপ্ত হৃদয়কে খোরাকমাত্র দিতেছে না, ইহাতে মহেন্দ্রের পৌরুষাভিমান প্রতিদিন আহত হইয়া তাহার হৃদয় বিদ্রোহী হইয়া উঠিতেছিল। এলাহাবাদে কিছুদিন থাকিয়া জিরাইতে পাইলে সে বাঁচিয়া যায়― কিন্তু ইচ্ছার অনুকূল হইলেও বিনোদিনীর খেয়ালমাত্রে সম্মতি দিতে তাহার মন হঠাৎ বাঁকিয়া দাঁড়াইল; সে রাগ করিয়া কহিল, “যখন বাহির হইয়াছি তখন যাইবই। ফিরিতে পারিব না।”

 বিনোদিনী কহিল, “আমি যাইব না।”

 মহেন্দ্র কহিল, “তবে তুমি একলা থাকো, আমি চলিলাম।”

 বিনোদিনী কহিল, “সেই ভালো।” বলিয়া দ্বিরুক্তিমাত্র না করিয়া ইঙ্গিতে মুটে ডাকিয়া স্টেশন ছাড়িয়া চলিল।

 মহেন্দ্র পুরুষের কর্তৃত্ব-অধিকার লইয়া অন্ধকারমুখে বেঞ্চে বসিয়া রহিল। যতক্ষণ বিনোদিনীকে দেখা গেল ততক্ষণ সে স্থির হইয়া থাকিল। যখন বিনোদিনী একবারও পশ্চাতে না ফিরিয়া বাহির হইয়া গেল, তখন সে তাড়াতাড়ি মুটের মাথায় বাক্স-বিছানা চাপাইয়া তাহার অনুসরণ করিল। বাহিরে আসিয়া দেখিল, বিনোদিনী একখানি গাড়ি অধিকার করিয়া বসিয়াছে। মহেন্দ্র কোনো কথা না বলিয়া গাড়ির মাথায় মাল চাপাইয়া কোচবাক্সে চড়িয়া বসিল। নিজের অহংকার খর্ব করিয়া গাড়ির ভিতরে বিনোদিনীর সম্মুখে বসিতে তাহার আর মুখ রহিল না।

 কিন্তু গাড়ি তো চলিয়াছেই। এক ঘণ্টা হইয়া গেল, ক্রমে শহরের বাড়ি ছাড়াইয়া চষা মাঠে আসিয়া পড়িল। গাড়োয়ানকে প্রশ্ন করিতে মহেন্দ্রের লজ্জা করিতে লাগিল; কারণ পাছে গাড়োয়ান মনে করে ভিতরকার স্ত্রীলোকটিই কর্তৃপক্ষ, কোথায় যাইতে হইবে তা’ও সে এই অনাবশ্যক পুরুষটার সঙ্গে পরামর্শ করে নাই। মহেন্দ্র রুষ্ট অভিমান মনে মনে পরিপাক করিয়া স্তব্ধভাবে কোচবাক্সে বসিয়া রহিল।

 গাড়ি নির্জনে যমুনার ধারে একটি সযত্নরক্ষিত বাগানের মধ্যে আসিয়া থামিল। মহেন্দ্র আশ্চর্য হইয়া গেল। এ কাহার বাগান, এ বাগানের ঠিকানা বিনোদিনী কেমন করিয়া জানিল।

 বাড়ি বন্ধ ছিল। হাঁকাহাঁকি করিতে বৃদ্ধ রক্ষক বাহির হইয়া আসিল। সে কহিল, “বাড়িওয়ালা ধনী, অধিক দূরে থাকেন না— তাঁহার অনুমতি লইয়া আসিলেই এ বাড়িতে বাস করিতে দিতে পারি।”