পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
২১৫

 বিনোদিনী মহেন্দ্রের মুখের দিকে একবার চাহিল। মহেন্দ্র এই মনোরম বাড়িটি দেখিয়া লুব্ধ হইয়াছিল; দীর্ঘকাল পরে কিছুদিন স্থিতির সম্ভাবনায় সে প্রফুল্ল হইল, বিনোদিনীকে কহিল, “তবে চলো, সেই ধনীর ওখানে যাই, তুমি বাহিরে গাড়িতে অপেক্ষা করিবে, আমি ভিতরে গিয়া ভাড়া ঠিক করিয়া আসিব।”

 বিনোদিনী কহিল, “আমি আর ঘুরিতে পারিব না— তুমি যাও, আমি ততক্ষণ এখানে বিশ্রাম করি। ভয়ের কোনো কারণ দেখি না।”

 মহেন্দ্র গাড়ি লইয়া চলিয়া গেল। বিনোদিনী বুড়া ব্রাহ্মণকে ডাকিয়া তাহার ছেলেপুলের কথা জিজ্ঞাসা করিল; তাহারা কে, কোথায় চাকরি করে, তাহার মেয়েদের কোথায় বিবাহ হইয়াছে। তাহার স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ শুনিয়া করুণ স্বরে কহিল, “আহা, তোমার তো বড় কষ্ট! এই বয়সে তুমি সংসারে একলা পড়িয়া গেছ। তোমাকে দেখিবার কেহ নাই।”

 তাহার পরে কথায় কথায় বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারীবাবু এখানে ছিলেন না?”

 বৃদ্ধ কহিল, “হাঁ, কিছুদিন ছিলেন তো বটে। মাজি কি তাহাকে চেনেন।”

 বিনোদিনী কহিল, “তিনি আমাদের আত্মীয় হন।”

 বিনোদিনী বৃদ্ধের কাছে বিহারীর বিবরণ ও বর্ণনা যাহা পাইল, তাহাতে আর মনে কোনো সন্দেহ রহিল না। বুড়াকে দিয়া ঘর খুলাইয়া কোন্ ঘরে বিহারী শুইত, কোন্ ঘর তাহার বসিবার ছিল, তাহা সমস্ত জানিয়া লইল! তাহার যাওয়ার পর হইতে ঘরগুলি যে বন্ধ ছিল তাহাতে মনে হইল, যেন সেখানে অদৃশ্য বিহারীর সঞ্চার সমস্ত ঘর ভরিয়া জমা হইয়া আছে, হাওয়ায় যেন তাহা উড়াইয়া লইয়া যাইতে পারে নাই। বিনোদিনী তাহা ঘ্রাণের মধ্যে হৃদয় পূর্ণ করিয়া গ্রহণ করিল, স্তব্ধ বাতাসে সর্বাঙ্গে স্পর্শ করল। কিন্তু বিহারী যে কোথায় গেছে, সে সন্ধান পাওয়া গেল না। হয়তো সে ফিরিতেও পারে—স্পষ্ট কিছুই জানা নাই। বৃব্ধ তাহার প্রভুকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসিয়া বলিবে বিনোদিনীকে এরূপ আশ্বাস দিল।

 আগাম ভাড়া দিয়া বাসের অনুমতি লইয়া মহেন্দ্র ফিরিয়া আসিল।