পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
২১৯

তোমার মৃত্যু কামনা করি। তুমি আমারও হইয়ো না, তুমি বিহারীরও হইয়ো না। তুমি যাও। আমাকে ছুটি দাও। আমার মা কাঁদিতেছেন, আমার স্ত্রী কাঁদিতেছে― তাঁহাদের অশ্রু আমাকে দূর হইতে দগ্ধ করিতেছে। তুমি না মরিলে, তুমি আমার এবং পৃথিবীর সকলের আশার অতীত না হইলে, আমি তাহাদের চোখের জল মুছাইবার অবসর পাইব না।

 এই বলিয়া মহেন্দ্র ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। বিনোদিনী একলা পড়িয়া আপনার চারি দিকে যে মোহজাল রচনা করিতেছিল তাহা সমস্ত ছিঁড়িয়া দিয়া গেল। চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া বিনোদিনী বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল― আকাশভরা জ্যোৎস্না শূন্য করিয়া দিয়া তাহার সমস্ত সুধারস কোথায় উবিয়া গেছে। সেই কেয়ারি-করা বাগান, তাহার পরে বালুকাতীর, তাহার পরে নদীর কালো জল তাহার পরে ও-পারের অস্ফুটতা, সমস্তই যেন একখানা বড়ো সাদা কাগজের উপরে পেন্সিলে-আঁকা একটি চিত্রমাত্র― সমস্তই নীরস এবং নিরর্থক।

 মহেন্দ্রকে বিনোদিনী কিরূপ প্রবলবেগে আকর্ষণ করিয়াছে, প্রচণ্ড ঝড়ের মতো কিরূপ সমস্ত শিকড়-সুদ্ধ তাহাকে উৎপাটিত করিয়াছে, আজ তাহা অনুভব করিয়া তাহার হৃদয় আরো যেন অশান্ত হইয়া উঠিল। তাহার তো এই-সমস্ত শক্তিই রহিয়াছে, তবে কেন বিহারী পূর্ণিমার রাত্রির উদ্‌বেলিত সমুদ্রের ন্যায় তাহার সম্মুখে আসিয়া ভাঙিয়া পড়ে না। কেন একটা অনাবশ্যক ভালোবাসার প্রবল অভিঘাত প্রত্যহ তাহার ধ্যানের মধ্যে আসিয়া কাঁদিয়া পড়িতেছে। আর-একটা আগন্তুক রোদন বারংবার আসিয়া তাহার অন্তরের রোদনকে কেন পরিপূর্ণ অবকাশ দিতেছে না। এই-যে একটা প্রকাণ্ড আন্দোলনকে সে জাগাইয়া তুলিয়াছে, ইহাকে লইয়া সমস্ত জীবন সে কী করিবে। এখন ইহাকে শান্ত করিবে কী উপায়ে।

 আজ যে-সমস্ত ফুলের মালায় সে নিজেকে ভূষিত করিয়াছিল তাহার উপরে মহেন্দ্রের মুগ্ধ দৃষ্টি পড়িয়াছিল জানিয়া সমন্ত টানিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিল। তাহার সমস্ত শক্তি বৃথা, চেষ্টা বৃথা, জীবন বৃথা— এই কানন, এই জ্যোৎস্না, এই যমুনাতট, এই অপূর্বসুন্দর পৃথিবী, সমস্তই বৃথা।

 এত ব্যর্থ, তবু যে যেখানে সে সেখানেই দাঁড়াইয়া আছে জগতে কিছুরই লেশমাত্র ব্যত্যয় হয় নাই। তবু কাল সূর্য উঠিবে এবং সংসার তাহার ক্ষুদ্রতম কাজটুকু পর্যন্ত ভুলিবে না― এবং অবিচলিত বিহারী যেমন দূরে ছিল তেমনি দুরে থাকিয়া ব্রাহ্মণ-বালককে তাহার বোধোদয়ের নূতন পাঠ অভ্যাস করাইবে।

 বিনোদিনীর চক্ষু ফাটিয়া অশ্রু বাহির হইয়া পড়িল। সে তাহার সমস্ত বল ও