পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২৪
চোখের বালি

 বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, যাহা মনে করিছে তাহা নহে। এ ঘরে কোনো কলঙ্ক স্পর্শ করে নাই। তুমি এই ঘরে একদিন শয়ন করিয়াছিলে―এ ঘর তোমার জন্যই উৎসর্গ করিয়া রাখিয়াছি, ঐ ফুলগুলা তোমারই পূজা করিয়া আজ শুকাইয়া পড়িয়া আছে। এই ঘরেই তোমাকে বসিতে হইবে।”

 শুনিয়া বিহারীর চিত্তে পুলকের সঞ্চার হইল। ঘরের মধ্যে সে প্রবেশ করিল। বিনোদিনী দুই হাত দিয়া তাহাকে খাট দেখাইয়া দিল। বিহারী খাটে গিয়া বসিল, বিনোদিনী ভূমিতলে তাহার পায়ের কাছে উপবেশন করিল। বিহারী ব্যস্ত হইয়া উঠিতেই বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, তুমি বোসো। আমার মাথা খাও, উঠিয়ো না। আমি তোমার পায়ের কাছে বসিবারও যোগ্য নই, তুমি দয়া করিয়াই সেখানে স্থান দিয়াছ। দূরে থাকিলেও এই অধিকারটুকু আমি রাখিব।”

 এই বলিয়া বিনোদিনী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পরে হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া কহিল, “তোমার খাওয়া হইয়াছে ঠাকুরপো?”

 বিহারী কহিল, “স্টেশন হইতে খাইয়া আসিয়াছি।”

 বিনোদিনী। আমি গ্রাম হইতে তোমাকে যে চিঠিখানি লিখিয়াছিলাম, তাহা খুলিয়া, কোনো জবাব না দিয়া, মহেন্দ্রের হাত দিয়া আমাকে ফিরাইয়া পাঠাইলে কেন।

 বিহারী। সে চিঠি তো আমি পাই নাই।

 বিনোদিনী। এবারে মহেন্দ্রের সঙ্গে কলিকাতায় কি তোমার দেখা হইয়াছিল।

 বিহারী। তোমাকে গ্রামে পৌঁছাইয়া দিবার পরদিন মহেন্দ্রের সঙ্গে দেখা হইয়াছিল, তাহার পরেই আমি পশ্চিমে বেড়াইতে বাহির হইয়াছিলাম, তাহার সঙ্গে আর দেখা হয় নাই।

 বিনোদিনী। তাহার পূর্বে আর-এক দিন আমার চিঠি পড়িয়া উত্তর না দিয়া ফিরাইয়া পাঠাইয়াছিলে?

 বিহারী। না, এমন কখনোই হয় নাই।

 বিননাদিনী স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার পরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “সমস্ত বুঝিলাম। এখন আমার সব কথা তোমাকে বলি। যদি বিশ্বাস কর তো ভাগ্য মানিব, যদি না কর তো তোমাকে দোষ দিব না; আমাকে বিশ্বাস করা কঠিন।”

 বিহারীর হৃদয় তখন আর্দ্র হইয়া গেছে। এই ভক্তিভারনম্রা বিনোদিনীর পূজাকে সে কোনোমতেই অপমান করিতে পারিল না। সে কহিল, “বোঠান,